বহু দশক ধরে আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার স্বপ্ন। ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়াও চলছে বহু দশক ধরে। 

১৯৪৫ সালের পর জাতিসংঘের ১৪০টির বেশি সদস্যরাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এখনো স্বীকৃতি দেয়নি। তার এ অবস্থান শুধু ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সম্পর্ককেই নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যের বিস্তৃত ভূরাজনীতি, আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান মূলত ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’ নীতির ওপর নির্ভরশীল। এর অর্থ হলো, ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি পক্ষের মধ্যে সরাসরি আলোচনা ও চুক্তির মাধ্যমে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়া উচিত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অনিশ্চিত স্বীকৃতি, ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য দাবির পক্ষে পদক্ষেপ না নেওয়া, সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলকে সামরিক–অর্থনৈতিক দিক থেকে তার সহায়তা করা মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতিবন্ধক।

যুক্তরাষ্ট্রের এ পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থান পশ্চিমা ও আরব জোটের মধ্যেও বিভাজন বাড়িয়েছে, শান্তি প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করেছে এবং ফিলিস্তিনি জনগণের আন্তর্জাতিক মর্যাদা সীমিত করেছে। বিপরীতে, ইসরায়েলকে রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে শক্তিশালী, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একগুঁয়ে ও বেপরোয়া রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে এ নীতি।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের অবস্থান:

২০১২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ফিলিস্তিনকে ‘সদস্যবহির্ভূত পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। পরে ২০১৫ সালের মধ্যে ১৩৮টি দেশ ফিলিস্তিনকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়. ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ অর্জনের প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করা হয়, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তা ভেটো দিয়ে থামায়। পরবর্তী মাসে (মে ২০২৪) সাধারণ অধিবেশনে একটি প্রস্তাব পাস হয়। এ প্রস্তাব ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের ‘পূর্ণ সদস্য হওয়ার যোগ্য’ হিসেবে বিবেচনা ও নিরাপত্তা পরিষদকে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে উৎসাহী হতে বলে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১৪৭টি রাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে জাতিসংঘে পূর্ণ সদস্যপদ এখনো হয়নি ফিলিস্তিনের। চলতি সপ্তাহে শুরু হতে যাওয়া সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে আরও কয়েকটি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে চলেছে। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র এতে খুশি নয়।

বিশ্ব মুসলিমদের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ আল–আকসা।

ঐতিহাসিক পটভূমি: ‘দুই রাষ্ট্রের সমাধান’

বিশ শতকের শেষ ভাগ থেকে ‘দুই রাষ্ট্রের সমাধান’ ফিলিস্তিন-ইসরায়েল শান্তিপ্রক্রিয়ার মূল কাঠামো হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এ সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সব প্রশাসন মূলত এই নীতিকে সমর্থন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র সব সময় বলে এসেছে যে, ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে হতে হবে, এক তরফা বা আন্তর্জাতিক চাপের মাধ্যমে নয়। ১৯৪৮ সালে দখলদার ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা, ১৯৬৭ সালে ছয় দিনের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ ও ১৯৯৩ সালের অসলো শান্তিচুক্তি- সব মিলিয়ে ‘দুই রাষ্ট্র সমাধানের’ রূপরেখা তৈরি হয়েছে।

মার্কিন প্রশাসনের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের দাবি, এক তরফাভাবে স্বীকৃতি শান্তি আলোচনায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে, ‘উগ্রপন্থী’ গোষ্ঠীকে উৎসাহিত করতে পারে এবং সীমান্ত, নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক অচলাবস্থা তৈরি করতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র–ইসরায়েল কৌশলগত সম্পর্ক:

যুক্তরাষ্ট্রের ফিলিস্তিন নীতি প্রায়ই তার ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কৌশলগত সম্পর্ক দিয়ে প্রভাবিত। সেই ১৯৪৮ সাল থেকে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর যুক্তরাষ্ট্র সেনা সাহায্য, উন্নত অস্ত্র সরবরাহ, গোয়েন্দা তথ্য ও কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে এসেছে দেশটিকে। এই সমর্থনের মধ্যে শুধু মার্কিন অস্ত্র বিক্রি নয়; ইসরায়েলকে সাইবার নিরাপত্তা, সামরিক প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধকৌশলীয় পরামর্শ প্রদানও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, একতরফা ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া হলে ইসরায়েলের সঙ্গে এ কৌশলগত জোটে ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ লক্ষণ তৈরি হতে পারে। ইসরায়েলপন্থী লবিগুলো, যেমন ‘এআইপিএসি’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনকে এমন পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত রাখে।

ফিলিস্তিন সরকারের সক্ষমতা:

যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের সক্ষমতা নিয়েও সন্দেহ পোষণ করে। দেশটির যুক্তি, ফাতাহ (পশ্চিম তীর) ও হামাসের (গাজা) মধ্যে বিভাজন ফিলিস্তিনের স্বীকৃতির জন্য উপযুক্ত নয়। ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসকে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠন হিসেবে মনে করে। গাজা ও পশ্চিম তীরে প্রশাসনিক অচলাবস্থা, মানবিক সংকট, বিদ্যুৎ ও পানীয় জলের অভাব- এসবও ফিলিস্তিনকে একটি কার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে পরিচালিত হতে ব্যর্থ করবে বলে বিশ্বাস যুক্তরাষ্ট্রের। এর ফলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেও ফিলিস্তিনের জন্য রাষ্ট্র পরিচালনা চ্যালেঞ্জপূর্ণ হবে।

আন্তর্জাতিক আইন ও আদালতের প্রভাব:

আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) ২০২৪-এর পরামর্শমূলক রায় হলো, ১৯৬৭ সাল থেকে ইসরায়েলের ফিলিস্তিনি অঞ্চল (গাজা, পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম) দখল করা অবৈধ। ইসরায়েলকে দ্রুত এ দখল ছাড়তে হবে। আবার দখলকৃত স্থানে ইহুদি বসতি নির্মাণ, এর সম্প্রসারণ ও শিক্ষানীতি বৈধ নয়।

এদিকে, ২০১৫ সালে রোম সনদে স্বাক্ষর করেছে ফিলিস্তিন। এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে (আইসিসি) গাজা ও পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্তের এখতিয়ার দিয়েছে। এসব আইনি ভিত্তি শক্তিশালী হলেও ফিলিস্তিনকে কার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বাধা এখনো রয়ে গেছে।

মার্কিন নীতি ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতি:

ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি যুক্তরাষ্ট্রের শুধু পররাষ্ট্রনীতি নয়, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থক রিপাবলিকানরা সাধারণত এ স্বীকৃতির বিরুদ্ধে। তবে, বিরোধী ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে প্রগতিশীলেরা স্বীকৃতির পক্ষে। কিন্তু ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতৃত্ব এ ব্যাপারে সতর্ক।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট, কংগ্রেস ও জনগণের মতামতের ভারসাম্য বিবেচনা করে পররাষ্ট্রনীতি গড়ে ওঠে। কংগ্রেসের প্রস্তাব ও জনমতের চাপ প্রগতিশীলদের ওই স্বীকৃতির দাবির পক্ষে সহায়ক। তবে রিপাবলিকান বিরোধ এ ক্ষেত্রে শক্তিশালী। গাজা ও পশ্চিম তীরের মানবিক সংকট যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বজুড়েই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জোরালো করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের নীতি অনুযায়ী, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে সরাসরি আলোচনার বাইরে স্বীকৃতি মানবিক সমস্যার সমাধান করবে না। এর পরিবর্তে ফিলিস্তিনে সাহায্য, পুনর্গঠন কর্মসূচি ও প্রশাসনিক সংস্কারের ওপর জোর দেওয়া উচিত। সমালোচকেরা মনে করেন, এটি কার্যকর পদক্ষেপকে বিলম্বিত করছে।

মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতি:

মিসর, জর্ডান ও উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেশটির মধ্যপ্রাচ্যের নীতি নির্ধারণে প্রভাব ফেলে। অনেক আরব দেশ ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে হলেও নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দেয় তারা। আরব দেশগুলোর এ বিভক্তিকে কাজে লাগাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটন ‘ভারসাম্য’ বজায় রাখতে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিচ্ছে না।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা:

যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের তরুণ নেতৃত্ব ও প্রগতিশীল ডেমোক্র্যাটরা স্বীকৃতির পক্ষে ক্রমেই বেশি শক্তিশালী কণ্ঠস্বর তুলছে। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, রিপাবলিকানদের বিরোধ, নির্বাচনী চাপ ও মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত বিবেচনা ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার পথে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বাধা সৃষ্টি করছে। ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক চাপ ও পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থন ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি প্রশ্নে মার্কিন নীতি পরিবর্তনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করছে।

পরিশেষ:

স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনের প্রতিষ্ঠার পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন অনেক বেশি। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও কৌশলগত অবস্থান, ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরীণ বিভাজন এবং মধ্যপ্রাচ্যের জটিল ভূরাজনীতি মিলিতভাবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করছে।

আইনি, মানবিক ও নৈতিক ভিত্তি থাকা সত্ত্বেও ফিলিস্তিন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি এখনো ‘আলোচনা ও সমঝোতার’ ওপর নির্ভরশীল। ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক চাপ, মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমা জোটের কৌশলগত অবস্থান, ফিলিস্তিন সরকারের সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা এবং মার্কিন কংগ্রেস ও জনমতের ভারসাম্য ফিলিস্তিনের স্বীকৃতির সম্ভাবনাকে প্রভাবিত করবে- এমনটাই মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

ফিলিস্তিনকে এখনো স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া না হলেও আন্তর্জাতিক আইন, মানবাধিকার রক্ষা, শান্তিপ্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধানের পথ খোলা রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য এটি একটি নীতি ও নৈতিকতার চ্যালেঞ্জ, যা শুধু রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ নয়; মানবিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতার প্রতিফলনও।

সূত্র: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, বিবিসি, আল–জাজিরা, দ্য গার্ডিয়ান ও রয়টার্স

By News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *