রকিব শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট থেকে পড়ালেখা শেষ করে ঢাকার স্বনামধন্য একটি বেসরকারি কলেজে শিক্ষকতা করেন। সুযোগ হলেই সেই দিনের গল্প মানুষের কাছে, তরুণদের কাছে বলতে চান এবং সেখান থেকে শিক্ষা নেবার অনুরোধ করেন।
গল্পটি কি?
২০১৪ সালের কথা।
ময়মনসিংহ জেলা শহর থেকে দূরের গ্রামীণ পরিবেশের কলেজের তুখোর, মেধাবী ছাত্র রকিব। স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান। সবাই সমীহ করে। এক নাম চেনে। সমগ্র পৃথিবী তার হাতের মুঠোয়।
বিজ্ঞান বিভাগের সকল বইয়ের উপর তার অগাধ আস্থা। পার্শবতী জেলা থেকে এক স্যার আসতেন। এক এক স্যারের সপ্তাহে দুই দিন করে ক্লাশ থাকে। রকিব সেই স্যারকে খুব পছন্দ করত। প্রতি সপ্তাহে স্যারকে ফোন দিত। স্যার যদি কলেজে যেত, তবেই না রকিবও কলেজে যেত।
এমন করতে করতে কলেজের গন্ডি ধীরে ধীরে শেষ হয়ে গেল। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় এ প্লাস পেয়ে সফলভাবে পাশ করল। এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার পালা।
রকিব ঢাকায় চলে আসল।
উদ্ভাস ইঞ্জিনিয়ারিং কোচিং এ পড়ালেখা শুরু করল। এখান থেকে সে নিজেকে অন্যের সাথে তুলনা করতে শুরু করল। তাতে সে মনে করছে আসলে সে তার উপজেলার কলেজ থেকে বিশাল এই জগত এবং পড়ালেখার বিষয়বস্তু খুব অল্পই জানতে পেরেছে।
এক মহাসমুদ্রে সে হাবু ডুবু খেতে শুরু করল। সে বুঝতে পারল, সে যা পড়েছে, তা দিয়ে আর যাই হোক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করার সুযোগ হবে না। তাকে আরও অনেক বেশি পড়তে হবে।
রকিব মনের সাথে যুদ্ধ করে চলেছে। তাকে জয়ী হতেই হবে। সে বাংলাদেশের সরকারি প্রথমসারির বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়বে বলে মনস্থির করে নতুন উদ্দ্যমে যাত্রা শুরু করল।
এক সময় সে মনে করল, সময় মাত্র তিন মাস। এই তিন মাসে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষায় বসলে কোনভাবেই চান্স হবে না। তাই দ্বিতীয়বারের চিন্তা মাথায় নিয়ে সামনে এগোতে থাকে। সেই আশার উপর ভর করে প্রথমসারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবেদন না করে শুধু পড়াশোনায় মশগুল থাকল। কিন্তু একেবারে শেষের দিকে এসে সরকার সিদ্ধান্ত নিল শিক্ষার্থীরা যারা প্রথমবার চান্স পাবে না তারা দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দেবার সুযোগ পাবে না।
আছড়ে পড়ে মাথায় বাজ।
সহপাঠীদের এখনো কোথাও চান্স পায়নি। তারপর আবার এই খবর। এই অবস্থার মধ্যে দিয়ে রকিব মোটামুটি একটা প্রস্তুতি গ্রহণ করে ফেলেছে।
অবশিষ্ট দুই একটা বিশ্ববিদ্যালয় আছে সেখানে সে পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে এই মৌসুমে বাস, ট্রেন এবং আবাসিক হোটেল, আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি, বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে ছাত্র-ছাত্রী এবং অভিভাবকদের ব্যাপক চাপ থাকে।
রকিব হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর থেকে ট্রেনে চেপে আসছে। ফাঁকা সীট না পেয়ে স্ট্যান্ডিং টিকেট কেটে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে। ট্রেনে সে কোনমতে উঠতে পেরেছে। নিঃশ্বাস নিতেও সে পারছে না। সাথে থাকা ব্যাগটি মাথায় নিয়ে কোনমতে দাঁড়িয়ে আছে। দুইটি হাত নামিয়ে যে হাতকে একটু বিশ্রাম দিবে তাও পারছে না।
ট্রেনের টয়লেটের দরজা খুলে সেখানেও পাঁচজন দাঁড়িয়ে আছে। তারা সবাই ছাত্র। এভাবেই সময় গড়িয়ে যায়। অবশেষে আসল নামার পালা। এখন এই পরিস্থিতিতে কিভাবে নামবে বুঝতে পারছে না। শেষে আরও কয়েকজন বন্ধু এবং অন্যান্য যাত্রীর পরামর্শ নিয়ে রকিব এবং তার বন্ধুরা সাথে থাকা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জানালা দিয়ে ফেলে দিয়ে দরজা দিয়ে নামার চেষ্টা করতে লাগল।
কিন্তু বিধি বাম।
একটা ছোট স্টেশনে বড় জোড় পাঁচ মিনিট দাঁড়ায়। অবশেষে ট্রেন নড়তে শুরু করল কিন্তু তারা যে নামতেই পারেনি এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সমেত ব্যাগ বাইরে ফেলে দিয়েছে।
এখন কি করবে?
কিংকর্তব্যবিমুঢ়!
ততক্ষণে ট্রেনের গতিটা বেশ উঠে গেছে। কিছুক্ষণ পরেই রকিব দেখে অন্য বন্ধুরা সবাই ট্রেনের জানালা দিয়ে ধপ্ ধপ্ করে লাফ দিচ্ছে। ওদের দেখাদেখি সেও লাফ দিল। বন্ধুরা সবাই নিজ নিজ ব্যাগ নিয়ে হাঁটা শুরু করল কিন্তু রকিব লাফ দিয়ে আর উঠতে পারছে না। রকিবের এক পা ভেঙ্গে গেছে। বন্ধুরা ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিয়ে মাইক্রোবাসে করে রকিবের গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে দেয়। ডাক্তার এক টানা দুই মাস বেড রেষ্ট দিয়েছে। এর মাঝে সে হাঁটাচলা কিছুই করতে পারবে না।
রকিব অস্থির!
কেন?
তার পা ভেঙ্গেছে। কিন্তু মন ভাঙ্গেনি। সে উঠে বসে, পড়ে এবং গভীর স্বপ্নে বিভোর। তাকে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেই হবে।
এবার ভাঙ্গা পা নিয়েই সে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেটে বন্ধুদের সহায়তায় পরীক্ষা দেয়।
এবার সে ভাঙ্গা পা নিয়েই আবার কুমিল্লা যাবে। অন্য বন্ধুরা কেউ বাসে যাবে না বা অন্য কোন উপায়ে যাবে না যেখানে খরচ বেশি হয়।
রকিব তো গ্রামের ছেলে! তাই বন্ধুদের এবং বড়দের সহায়তা সে আবারো ট্রেনে কুমিল্লা যাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়।সেই একই ভিড়। কোন মতে ভিড় ঠেলে একটি বগিতে উঠে পড়ে। কিন্তু একি হচ্ছে রকিবের। এতো ভিড়ের মধ্যে রকিব তো নিঃশ্বাসই নিতে পারছে না। ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। প্রচন্ড শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে, সে মারা যাবে। সে ভাবছে, পরের ষ্টেশনে আসলে সে বের হবে এবং অন্য বগিতে চেষ্টা করবে। বলতে বলতেই ট্রেন কোন একটা ষ্টেশনে থামল।
রকিব কোন মতে ঠেলেঠুলে প্রাণপণ চেষ্টা করে কাছে থাকা ব্যাগটি আর এক বন্ধুর কাছে রেখে বগি থেকে নেমে আসে।
সে দেখছে, অন্য কোন বগিতে তো সে উঠতেই পারবে না। দেখতে দেখতেই আবারো ট্রেনে হুইসেল পড়ে গেছে। ট্রেন একটু একটু করে নড়তে শুরু করেছে। তখন সে দেখল ট্রেনের ইঞ্জিনের সামনে, বাইরে একটু ফাঁকা জায়গা আছে। একটু আগে কিছু লোককে সেখানে বসে থাকতে দেখেছে। দেরী না করে চট করে সে সেখানে উঠে বসে।
নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস।
বাইরে হাড় কাঁপাঁনো শীত। ঘন কুয়াশা।বগিতে মানুষের গায়ের গরম, একে অন্যের নিঃশ্বাসের গরম। গায়ের সাথে গা লেপ্টে থেকে এত গরম লেগেছিল যে, আস্তে আস্তে শরীরের সকল গরম কাপড় খুলে ফেলেছে এবং তা বন্ধুদের কাছে রেখে বাইরে চলে এসেছে। এখন তার গায়ে আছে কেবল একটি ফুল হাতা সুয়েটার।
আলো জ্বালিয়ে কুয়াশার চাদর ফেরে ট্রেন চলছে।
২০০ কিলোমিটার গতির বাতাস এসে রকিবের বুকে লাগছে। সে শীতে থরথর করে কাঁপছে। সব দেখছে। কিভাবে ট্রেন নদ-নদী, জঙ্গল, মাঠ, ধানক্ষেত, হাট-বাজার, খাল-বিল পিছনে ফেলে কুমিল্লার দিকে এগিয়ে চলেছে।
রকিব দুই হাত গুটিশুটি মেরে বসে থাকতে পারছে না। সে একটি বিপদজনক জায়গায় বসে আছে। একটু যদি ঝিমানি আসে, তবে নিশ্চিত ট্রেন লাইনের উপর পড়ে যাবে এবং পরেরটা ইতিহাস হয়ে যাবে। বার বার হাত পরিবর্তন করে সময় অতিক্রম করার ব্যর্থ চেষ্টা। যখন বাম হাত দিয়ে একটা লম্বা রড ধরে রাখে, তখন ডান হাতটি শরীরের সাথে লাগিয়ে রেখে গরম করে। আর ভাবে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেই হবে এবং ট্রেন থামলে আবার বগির ভিতরে চলে যাব। আর এ কারণেই আগের যাত্রীরা এই জায়গা ছেড়ে দিয়েছে।
নানান রকম শব্দে ট্রেন চলছে। কখনও ঝক ঝকা ঝক, গম্ গম্, যখন নিচে পানি তার উপর রেল লাইন, তখন এক অন্য রকমের শব্দ। ট্রেন আর থামে না। থামল একেবারে থামে না। থামল একবোরে কুমিল্লা এসে।
পরীক্ষা দিল রকিব ও তার বন্ধুরা। রকিবের মনোবল খুব শক্ত। সারা রাতের বিভৎস এবং ভয়ংকর ভ্রমন তাকে কোনভাবেই কাবু করতে পারল না।
ফেরার পথে রকিব ও তার বন্ধুরা এবার সবাই ট্রেনের ছাদে উঠেছে।
রকিব ভাবছে, যে ছেলে আগে কখন ময়মনসিংহের বাইরে আসেনি। যে ছেলে, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালযকে একটি সরকারি পার্ক মনে করত। যেখানে মানুষ কেবল শুক্রবারে বেড়াতে যায়। সেই ছেলে আজ ট্রেনের ছাদে উঠে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় যাবে।
ট্রেনের ছাদ একটু অমসৃণ। কোন কোন বগিতে হালকা মরিচা ধরে আছে। এরই মধ্যে কিছু মানুষ ছাদে নিয়মিত যাতায়াত করে। হকাররা তাদের ছোট ছোট ঝুড়িতে করে হেঁটে হেঁটে কেউ বাদাম, কেউ ছোলা, কেউ পানি কিংবা কেউ বা ঝাল মুড়ি বিক্রি করছে।
রকিবদের পেটে রাজ্যের রাক্ষস ভর করেছে। ক্ষুধায় যেন তাদের চলার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে। কাগজের ঠোঙ্গায় মুড়ি নিল। বাতাসের তোড়ে মুড়ি মুখে দিলে মুখে না গিয়ে বাতাসে উড়ে যাচ্ছে। সবার মুড়ি একটি বড় পলিথিনে ভিতর ঢেলে মুখ আটকে রেখে, কোন মতে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে অতি সন্তর্পনে এক মুঠ মুড়ি নিয়ে আবার পলিথিনের মুখ চেপে ধরছে। মুড়ি সমতে হাত মুখের ভিতর ঢুকিয়ে দিলেই কেবল খেতে পারবে। সবাই যার যার স্যান্ডেলের উপর বসে আছে। এক বন্ধু একটু দূরে বসেছে। সে হাত টান করে করে, একটু এগিয়ে এসে মুড়ি পলিথিনের ভিতর থেকে নিচ্ছে। মুড়ি যথন সে নিচ্ছে, তখন পাছাটা একটু উঁচু হচ্ছে। মাঝে মাঝে লোহার কাভারড ব্রিজ আসলে সবাই মাথা নিচুঁ করে শুয়ে পড়ছে। এক হাতে মুড়ি খায় অন্য হাত দিয়ে স্যান্ডেল ধরে রাখে। এভাবে চলতে চলতে একসময় এক বন্ধুর শখের নতুন চামড়ার স্যান্ডেল জোড়া নিচে পড়ে যাচ্ছে দেখে মুড়ি ফেলে দিয়ে স্যান্ডেল ধরতে যায়।
স্যান্ডেল নিচে পড়ে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় বন্ধুও ট্রেন থেকে নিচে পড়তে পড়তে আটকে যায়। কারণ আর এক বন্ধু তার পা ধরে আছে। তার পা আর এক জন ধরে আছে। স্যান্ডেলওয়ালা বন্ধুর মাথা নিচে ঝুলছে ট্রেনের একদিকে, অন্যদিকে আর এক বন্ধু দুই পা নিচে ঝুলছে ট্রেনের আর এক পাশে আর মাঝখানে আর এক বন্ধু দুই পাশের বন্ধুর সেতু বন্ধন হয়ে কাজ করছে। তিনজনের অবস্থা বেগতিক। যেকোন সময় কারও সাথে আঘাত লেগে মৃত্যু অনিবার্য। বগির ভিতর থেকে ব্যপক হৈহুল্লোর শোনা যাচ্ছে। কেউ বলছে, চেন টেনে ধরো, চেন টেনে ধরো।
জীবনের গতিকে টেনে ধরেছে যান্ত্রিক গতি। পড়ে আছে খন্ড খন্ড মানব শরীরাংশ। আটকে আছে ট্রেনের জানালার সাথে, রেল লাইনের পাথর খন্ডের উপর, স্লীপারের উপর, রক্তে রঞ্জিত হয়েছে রেল লাইন, নিথর নিস্তব্ধ, খন্ড বিখন্ড দেহাবশেষ হাজারো তরুণের স্বপ্নের বাস্তবায়ন সীমানা অতিক্রম করে।
লেখকঃ শিক্ষা অফিসার, আগাখান একাডেমি, ঢাকা,বাংলাদেশ।