বাকস্বাধীনতা মানুষের মৌলিক অধিকার। বাকস্বাধীনতা বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা গণতান্ত্রিক সমাজের অন্যতম প্রধান ভিত্তি। এটি নাগরিকদের তাদের মতামত প্রকাশের অধিকার প্রদান করে, যা ব্যক্তি ও সমাজের অগ্রগতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে বর্তমান সময়ে এই মহান অধিকারটি অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তিপূজা ও ব্যক্তিগত আক্রোশের হাতিয়ারে পরিণত হচ্ছে, যা কেবল বাকস্বাধীনতার মূল উদ্দেশ্যকেই ব্যাহত করছেনা, বরং সমাজের মধ্যে বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা এবং বিভাজন সৃষ্টি করছে।
বাকস্বাধীনতার প্রকৃত সংজ্ঞা ও গুরুত্ব
বাকস্বাধীনতা বলতে বোঝায় এমন একটি অধিকার, যা নাগরিকদের তাদের মতামত, বিশ্বাস ও চিন্তা প্রকাশের স্বাধীনতা প্রদান করে । এটি ব্যক্তি এবং সমাজকে সুস্থ বিতর্ক, সমালোচনা ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে সহায়তা করে। একটি সুশৃঙ্খল ও সচেতন সমাজে বাকস্বাধীনতা অপরিহার্য, কারণ এর মাধ্যমে জনগণ তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং অসন্তোষ প্রকাশ করতে পারে, যা প্রশাসনিক বা সামাজিক কাঠামোর ত্রুটি সনাক্ত করে এবং সেগুলোর সমাধান নিশ্চিত করতে সহায়তা করে।
তবে বাকস্বাধীনতা ব্যবহারে অবশ্যই একটি দায়িত্ব বোধ থাকা উচিত। অযাচিত আক্রমণ, আক্রোশপূর্ণ বক্তব্য বা অন্ধ ব্যক্তি পূজার কারণে এই স্বাধীনতার অপব্যবহার হলে তা সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করে। তাই বাকস্বাধীনতার সঠিক এবং নৈতিক ব্যবহার নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
ব্যক্তিপূজা: বাকস্বাধীনতার বিকৃতি
ব্যক্তিপূজা বলতে বোঝায় এমন একটি সংস্কৃতি, যেখানে কোনো ব্যক্তি, নেতা বা সংগঠনের প্রতি অন্ধ আনুগত্য ও অতিরিক্ত প্রশংসা করা হয়। সমাজে নেতৃবৃন্দের প্রতি শ্রদ্ধাপ্রদর্শন একটি সুস্থ মানসিকতার অংশ হলেও, যখন এই শ্রদ্ধা সীমা ছাড়িয়ে যায় এবং সমালোচনার বাইরে থাকে, তখন এটি ব্যক্তি পূজা হয়ে ওঠে। এই ধরণের সংস্কৃতি জনগণের স্বাধীন মতামতকে বাধাগ্রস্ত করে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটায়।
যখন বাকস্বাধীনতা ব্যক্তিপূজায় পরিণত হয়, তখন সেই সমাজে সুস্থ আলোচনা এবং সমালোচনার জায়গা সংকুচিত হয়ে পড়ে। লোকেরা তখন কোনো ব্যক্তির সমালোচনা করতে ভয় পায় বা অনিচ্ছুক হয়ে পড়ে, কারণ সমালোচনা করা মানেই নেতার বিরুদ্ধে কথা বলা। এর ফলে, সমাজে একটি একপাক্ষিক ধারা তৈরি হয়, যা গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
উদাহরণস্বরূপ, একনায়কতান্ত্রিক শাসনের ক্ষেত্রে আমরা প্রায়ই দেখি যে, জনগণের বাকস্বাধীনতা খুব সীমিত হয় এবং নেতার প্রতি অন্ধ আনুগত্য প্রদর্শন করতে বাধ্য করা হয়। এই ধরনের সমাজে স্বাধীন মতামতের প্রকাশকে বিদ্রোহ বা রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যা প্রকৃত বাকস্বাধীনতার পরিপন্থী।ব্যক্তি পূজার এই সংস্কৃতি মানুষের স্বাধীন চিন্তা ও বিচার ক্ষমতাকে নষ্ট করে দেয় এবং সমাজকে স্থবির করে তোলে।
ব্যক্তিগত আক্রোশ: স্বাধীন মত প্রকাশের অবক্ষয়
ব্যক্তিগত আক্রোশ হচ্ছে একটি নেতিবাচক প্রবণতা, যেখানে মানুষ তার ব্যক্তিগত বিরোধ বা অসন্তোষ প্রকাশের জন্য বাকস্বাধীনতার অপব্যবহার করে। গণতান্ত্রিক সমাজে সমালোচনা ও মতপ্রকাশের অধিকার রয়েছে, তবে তা অবশ্যই যুক্তিপূর্ণ ও সঠিক হওয়া উচিত। কিন্তু যখন এটি ব্যক্তিগত শত্রুতা, বিদ্বেষ বা প্রতিশোধের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তখন এটি সমাজে বিশৃঙ্খলা ও বিভাজনের সৃষ্টি করে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রসার ও জনপ্রিয়তার কারণে ব্যক্তিগত আক্রোশের প্রকাশ আজকাল খুবই সহজ হয়ে গেছে। মানুষ যেকোনো বিষয় নিয়ে সহজেই কুরুচি পূর্ণ মন্তব্য করতে পারে, যা কোনো সঠিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে নয়, বরং শুধুমাত্র ব্যক্তিগত অসন্তোষের ফলাফল। এরফলে, জনমনে বিভ্রান্তি, অসন্তোষ এবং উত্তেজনা তৈরি হয়।
এটি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করেনা, বরং সামাজিক স্থিতিশীলতাকেও নষ্ট করে।ব্যক্তি আক্রমণ বা আক্রোশপূর্ণ বক্তব্য সামাজিক ন্যায়বিচার এবং সমানাধিকারের ধারণাকেও ব্যাহত করে, যা বাকস্বাধীনতার প্রকৃত উদ্দেশ্যের পরিপন্থী।
বাকস্বাধীনতা ক্ষেত্রে শিষ্টাচার
বাকস্বাধীনতা যেন ব্যক্তি পূজা বা ব্যক্তিগত আক্রোশের মাধ্যম না হয়ে ওঠে, সেজন্য আমাদের নিম্মোক্ত কয়েকটি বিষয় মেনে চলা উচিত।
আইনের শাসন
বাক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে আইনের সঠিক প্রয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে তা করতে গিয়ে বাকস্বাধীনতার ওপর অযথা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা উচিত নয়। মানহানি, কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য বা হিংসাত্মক ভাষার ব্যবহার রোধে যথাযথ আইন থাকা প্রয়োজন, কিন্তু সেই আইন যেন মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত না করে।
আমাদের করণীয়
বাকস্বাধীনতা একটি গণতান্ত্রিক সমাজের মূলে থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। তবে এই অধিকার যেন ব্যক্তিপূজা বা ব্যক্তিগত আক্রোশের মূল প্রতিপাদ্য না হয়ে ওঠে, সে জন্য আমাদের সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে। গঠনমূলক সমালোচনা, শালীন মতপ্রকাশ এবং সঠিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বাকস্বাধীনতার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। তবেই আমরা একটি সুশৃঙ্খল ও গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম হব, যেখানে মতের অমিল থাকলেও তা সহিষ্ণুতা ও সংলাপের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব হবে।
# engr.ashik.info@gmail.com