চলছে আগস্ট মাস। বাঙালি জাতির শোকের মাস, বাঙালি জাতির হারানোর মাস। এই আগস্ট মাসের ১৫ তারিখেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের মহানায়ক হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মানবতার শত্রু ঘৃণ্য ঘাতকদের নির্মম বুলেট থেকে রক্ষা পায়নি শিশু শেখ রাসেলও। ইতিহাসের এই ঘৃণ্যতম হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধ চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলে বাংলার মাটিতে পাকিস্তানি চেতনা প্রতিষ্ঠা করা। ১৫ই আগস্ট ঘাতকের এই বুলেটগুলো ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে সেদিন শুধু হত্যা করেনি, হত্যা করেছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ, মুক্তিযুদ্ধ আর সংবিধানকে।
বাঙালি জাতিই বঙ্গবন্ধুর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছে। গত প্রায় ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতে গড়া দল ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’। অন্যান্য বারের মতো এবারও যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়েছে শোক দিবস।
ক্ষমতায় থাকার কারণে দেশে আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ার চেষ্টাকারী লোকজনের আধিক্য বেশ লক্ষণীয়। আওয়ামী লীগের প্রবীণ এবং ত্যাগী নেতারা প্রায়ই অভিযোগ করে থাকেন এই সব নব্য আওয়ামী লীগারদের ভিড়ে নাকি প্রকৃত আওয়ামী লীগার খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এই অভিযোগ যে একেবারে অমূলক, তা-ও কিন্তু নয়। অনেক জামায়াত নেতার ফুল দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগদানের ছবি পত্রপত্রিকার কল্যাণে প্রত্যক্ষ করেছে দেশবাসী। কোনো ব্যক্তিবিশেষের যুদ্ধাপরাধীদের সন্তানদের আওয়ামী লীগ করার ক্ষেত্রে নমনীয় মনোভাব হয়েছে দারুণভাবে সমালোচিত। এই নব্য আওয়ামী লীগাররা কতটুকু ধারণ করতে পারেন আওয়ামী লীগকে? কতটুকু ধারণ করতে পারেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনকে? তার রাজনৈতিক জীবনকে?
আমরা যদি বর্তমান সময়ের সবচেয়ে সফল প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবনের দিকে লক্ষ্য করি, তা-ও আমরা দেখব তিনি তৃণমূল স্তর থেকে রাজনীতি করা অসম্ভব কর্মীবান্ধব এক নেত্রী। তিনি ১৯৬৬-৬৭ সালে ছাত্রলীগ থেকে ইডেন কলেজের ছাত্রী সংসদের সহসভাপতি নির্বাচিত হন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থাকাকালে ছাত্রলীগের ‘রোকেয়া হল’ শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কন্যা তথা তত্কালীন আওয়ামী লীগের সভাপতির কন্যা হিসেবে জননেত্রী শেখ হাসিনা চাইলেই এমপি, মন্ত্রী বা আওয়ামী লীগের বড় কোনো পদে অধিষ্ঠিত হয়ে রাজনীতি শুরু করতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি।
তিনি তার পিতার রাজনৈতিক আদর্শকে ধারণ করেছেন বলেই রাজনীতি শুরু করেছেন তৃণমূল পর্যায় থেকে। নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন একজন কর্মীবান্ধব নেতা হিসেবে। এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, জননেত্রী শেখ হাসিনা যখন দলীয় প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হন, তখন তিনি দেশে উপস্থিত ছিলেন না। সুতরাং তার বিন্দুমাত্র প্রভাব বিস্তারের সুযোগ ছিল না। আওয়ামী লীগের কর্মী এবং সমর্থকরাই তাকে দলীয় প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেন। এটি সম্ভব হয়েছে শুধু তৃণমূল স্তরে তার অভাবনীয় জনপ্রিয়তার কারণে। জননেত্রী শেখ হাসিনা চূড়ান্ত কর্মীবান্ধব নেতা হওয়ার কারণে, আওয়ামী লীগের কর্মীরা জানতেন, তিনি পারবেন আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে দলের হাল ধরতে, দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে। এমনকি টানা ৩৭ বছরের অধিক সময় ধরে সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে সফলভাবে দলের হাল ধরে থাকার পরও তার জনপ্রিয়তা একটুও কমেনি, বরং দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আজ যখন তিনি নিজেই আওয়ামী লীগে নতুন নেতৃত্বের কথা ভাবতে বলেন, তার কর্মীরা সমস্বরে ‘না না’ বলে ওঠেন। আওয়ামী লীগের সব স্তরের নেতাকর্মীরা বিশ্বাস করেন, তাদের শেষ ভরসাস্থল ‘জননেত্রী শেখ হাসিনা’। আর এসব সম্ভব হয়েছে তার কর্মীবান্ধব গুণটির কারণেই।
কাজেই যারা নেতা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন বা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের পতাকাতলে আশ্রয় পেতে চান তাদের প্রতি অনুরোধ, কোনো বিশেষণ-গর্বে গর্বিত না হয়ে, বিশেষ কোনো কারণে শিহরিত না হয়ে আগে নিজেকে আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে তৈরি করুন, মূল্যায়ন করতে শিখুন আপনার পাশের সহযোদ্ধাদের। তা না হলে ভুলে যাবেন না, আওয়ামী লীগে যেমন বঙ্গবন্ধুর উদাহরণ আছে, ঠিক তেমনি আছে তার প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি এবং সম্পাদকের নিভে যাওয়ার ইতিহাস। মনে রাখতে হবে যে, আওয়ামী লীগ মিলিটারি ব্যারাকে সামরিক শাসকের উদরে জন্ম নেওয়া কোনো দল নয়। ক্ষমতার মসনদে বসে এই দলের জন্ম হয়নি। জন্ম হয়েছে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, পাকিস্তানি সামরিক-জান্তার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে গণ-মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। তাই জন্মলগ্ন থেকে আওয়ামী লীগ পেয়েছে গণ-মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন। এই গণমানুষের ভালোবাসার কারণেই শত ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে আজও আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে।
বাহারি রঙের মুজিব কোট পরে, ব্যানার ফেস্টুন টাঙিয়ে , সেলফি তুলে বা যাত্রা পালার ঢঙে চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলে আওয়ামী লীগের নেতা হওয়া যায় না। নেতা হওয়ার পূর্বশর্ত কর্মীবান্ধব হওয়া, কর্মীদের দিকে তর্জনী তুলে কথা বলা নয়। ভুলে গেলে চলবে না তর্জনী তোলা এক জনকেই মানায়, ‘আমার’ বলাটাও এক জনকেই শোভা পায়, বাকি যারা সেই চেষ্টা করে, তাদের ভাঁড়ের মতো লাগে।
লেখক: কলামিস্ট ও অ্যাকটিভিস্ট