1. chalanbeel.probaho@gmail.com : News :
  2. khokanhaque.du@gmail.com : khokan :
মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:১২ অপরাহ্ন

বিশেষ সাক্ষাৎকার
বীর মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ সিরাজুল ইসলাম শিশির

মাহমুদুল হক খোকন
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৩
  • ২৪৪ বার পঠিত

ডাঃ সিরাজুল ইসলাম শিশির। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক। শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের ভিজিটিং প্রফেসর। মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী। চলনবিলের একজন কৃতিসন্তান। লাহোরের কিং এডওয়ার্ড মেডিকেল কলেজে পড়াকালীন সময়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। এরপর দেশ মাতৃকার টানে পাকিস্তান থেকে চলে আসেন বাংলাদেশে। যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। ট্রেনিং নিয়েছেন ভারতের দেরাদুনে। ছিলেন গেরিলা যুদ্ধের কমান্ডার। যুদ্ধ শেষে উচ্চ শিক্ষার জন্য চলে যান আমেরিকা। সেখানেই ছিলেন দীর্ঘকাল। সম্প্রতি তিনি দেশে ফিরে এসেছেন। মুক্তিযুদ্ধে তার অংশগ্রহণ, পড়াশোনা, সামজিক কাজকর্ম অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেছেন চলনবিল প্রবাহের সাথে। ঢাকার উত্তরায় নিজ বাসভবনে তার সাক্ষাতকার নিয়েছেন চলনবিল প্রবাহ পত্রিকার  সম্পাদক মাহমুদুল হক খোকন।

চলনবিল প্রবাহঃ প্রথমেই জানতে চাইবো আপনার পরিবার, বাল্যকাল এবং পড়াশোনা নিয়ে। বিষয়ে যদি আমাদের কিছু বলেন।
ডা: সিরাজুল ইসলাম শিশিরঃ  আমার জন্ম হয় নাটোর জেলার গুরুদাসপুর থানার খুবজীপুর গ্রামে এক কৃষক পরিবারে। আমার আব্বা একজন ব্যবসায়ী ছিলেন এবং ব্যবসায়ের পাশাপাশি তিনি কৃষিকাজও করতেন। আব্বা তার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা ভাই বোনের দিক থেকে অনেক বড় একটা পরিবার হয়ে যাই। আমরা আট ভাই ছয় বোন। আমার ভাইয়েরা প্রত্যেকেই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত ও ব্রিলিয়াান্ট ছাত্র ছিলেন। আমিও সেই ভাবে ভাইদের স্নেহ ভালবাসা নিয়ে তাদের দেখানো পথ অনুসরণ করে লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করি। প্রথমে আমি গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে পড়াশোনা করেছি। সেখানে শুধু আমার লেখাপড়ার জীবনই না আমার সাংস্কৃতিক জীবনেরও হাতেখড়ি ওখানেই হয়। আমাদের শিক্ষকরা আমাদের শুধু লেখাপড়ার দিক থেকে ভাল করি নাই, ওনারা আমাদের সবদিক থেকেই এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে বেশি করে শিখিয়েছেন ও মানুষ করেছেন। আমাদের খুবজীপুর স্কুলের বয় স্কাউট এর খুবই নামকরা একটা দল ছিল। আমিও ভাগ্যবান ছিলাম যে আমি বয়স্কাউট এর একজন অংশ হিসেবে ছিলাম। যদিও আমার বয়স অত নয় তাই আমি হাফ স্কাউট এ ছিলাম। খুবজীপুর যদিও সেই সময় একটা অনুন্নত গ্রাম, একটা অজপাড়া গ্রাম ছিল। সেই খুবজীপুর এখন পরিবর্তন হয়ে খুবই উন্নত একটা গ্রাম হয়েছে এবং সেখানে সব ধরনের প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । আমার বড় ভাই অধ্যাপক আব্দুল হামিদের নেতৃত্বে এবং উনার সারা জীবনের কর্মফল হিসেবে খুবজীপুরে এ সমস্ত প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এবং অঞ্চলের মানুষ এখন সেইটাকে অধ্যক্ষ আব্দুল হামিদ কমপ্লেক্স নামে নামকরণ করেছেন। যার ভিতরে ডিগ্রী কলেজ, হাই স্কুল, গার্লস হাই স্কুল, দাখিল মাদ্রাসা, ক্লাব, চলনবিল যাদুঘর ইত্যাদি রয়ে গেছে। এখান থেকে আমার ছাত্র জীবন শুরু হয়। এরপরে আমি পাবনা জেলা স্কুলে পড়াশোনা করেছি। সেখান থেকে আমি ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হই।

চলনবিল প্রবাহঃ আমরা জানি আপনি যখন ঢাকা কলেজে পড়তেন তখন আপনার সাথে বঙ্গবন্ধুর ছেলে শেখ কামাল আপনার ক্লাসমেট বন্ধু ছিল।
ডা: সিরাজুল ইসলাম শিশিরঃ   শেখ কামাল আমার বন্ধু ছিল । সেই সুবাদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথেও আমার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা আছে। যে কারণে এখনও তিনি আমাকে আপন ভাই এবং আমিও তাকে আপন বোনের মত দেখি।

চলনবিল প্রবাহঃ এর পরেই আপনি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলেন।
ডা: সিরাজুল ইসলামঃ  আমি ঢাকা কলেজ থেকে পাস করে মেডিকেল কলেজে পড়তে যাই। তখন পশ্চিম পাকিস্তান গভর্নরের দুটো স্কলারশিপ ছিল । পাকিস্তানের সবচেয়ে নামকরা কলেজ কিং এডওয়ার্ড মেডিকেল কলেজ এর জন্যে দুটো আসন নির্ধারিত ছিল। যেটাকে বলা হত ওয়েস্ট পাকিস্তান গভর্নর স্কলারশিপ। আমি সেটার জন্য দরখাস্ত করি এবং ভাগ্যক্রমে এবং আল্লাহ তায়ালার মেহেরবানীতে আমি সেই স্কলারশিপটা পাই । ১৯৬৯ সালে আমি কিং এডওয়ার্ড মেডিকেল কলেজে ভর্তি হই। সেখান থেকেই আমার বাংলাদেশ বা জাতীয়তাবোধ এবং বঙ্গবন্ধুর কথাগুলো ভালো লাগতে শুরু করে । আমি রাজনৈতিকভাবে আমি আকৃষ্ট হই ওয়েস্ট পাকিস্তান যাওয়ার পর থেকে এবং পরবর্তীতে আমি সেখান থেকে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেই।

চলনবিল প্রবাহঃ আপনি যখন পাকিস্তানেপড়াশোনা করছিলেন তখন বাঙালীদের প্রতি কি ধরনের বৈষম্য চোখে পড়েছে।

ডা: সিরাজুল ইসলাম শিশিরঃ  বৈষম্যগুলো বেশিরভাগ ছিল উন্নয়নের দিক থেকে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, রাস্তা ঘাট দেখলেই বোঝা যেত। আমার রুমমেট ছিল ইসলামাবাদের । আমি ঈদ করতে যেতাম ওর বাড়িতে। ইসলামাবাদ, রাওয়ালপিন্ডি বা বিভিন্ন যায়গায় যখন যেতাম তখন বুঝতাম যে পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশ কতটা অবহেলিত। দ্বিতীয়ত উন্নয়নের সব ছবি দেখতাম ওইখানে। কত রকমের উন্নয়ন হচ্ছে অথচ আমাদের পূর্ব পাকিস্তানে উন্নয়নের কোনো রকমের অ্যাকটিভিটিজ চোখে পড়ত না। অথচ আমি জানতাম যে পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস ছিল পূর্ব পাকিস্তান, পশ্চিম পাকিস্তান না। কোনো কিছুতেই আমাদের কোনো রিপ্রেজেন্টেটিয়েশন ছিল না। আর্মিতে বলি, নেভিতে বলি, এয়ারফোর্সে বলি , অর্থনৈতিক ডিসিশন মেকিং এ বলি কোনো কিছুতেই না। আমাদের স্কলারশিপ দেওয়া হত খুব কম , বিদেশ যাওয়া সুযোগ ছিল কম, বিদেশে চাকরি-বাকরি বাংলাদেশকে দিতই না। এগুলো যখন বঙ্গবন্ধু বলতেন সেগুলো তখন মনে আচড় কাঁটা শুরু করে। এবং আস্তে আস্তে ঘৃণার সৃষ্টি হতে শুরু করে এই ভেবে যে,  আমার দেশ একই দেশ অথচ এই বৈষম্য কেন? দামের দিক থেকে বৈষম্য ছিল। ওখানে সোনা-রূপার দাম কম ছিল আমরা বেশি দাম দিতাম। এরকম আমরা আস্তে আস্তে পড়াশোনা ফাঁকে ফাঁকে খোচা দেওয়া শুরু করে।

চলনবিল প্রবাহঃপাকিস্তান থেকে আপনি বাংলাদেশে ফিওে আসলেন কখন
ডা: সিরাজুল ইসলাম শিশিরঃ  যখন সত্তরের ইলেকশান আসল তখন যেহেতু আমি স্কলারশিপ পেতাম, আব্বা-আম্মা আমাকে টাকা-পয়সা পাঠাতেন সেজন্য আমার সমস্ত স্কলারশিপ এর টাকা তুলে, এমনকি ক্লাস ফেলে রেখে আমি পূর্বপাকিস্তানে চলে আসি। আমাদের শ্রদ্ধেয় অধ্যক্ষ ডাঃ মোবারক হোসেন সাহেব তখন ইলেকশান এ দাঁড়িয়েছিলেন । তখন উনার ক্যাম্পেইন   করার জন্য আমি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে চলে আসি। এসে আমার স্কলারশিপ এর সব টাকা খরচ করে উনার জন্য ক্যাম্পেইন করি। প্রায় দুই সপ্তাহ ক্যাম্পেইন করে বিপুল ভোটে বিজয়ী করে পরে আবার আমি পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যাই। ওখানে ফিরে যাওয়ার পর তখন তো আমরা সবাই জানি ইলেকশানের পর কি হল । নানা ধরনের পায়তারা করে ক্ষমতা দেওয়া হল না। আর একটা ঘটনা ঘটে । যেহেতু তারা বুঝতে পারছিল যে বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায় এলে কি হবে সেহেতু ইলেকশান এর পর পর তারা এত ম্যাসিভ কনস্ট্রাকশন শুরু লাহোরে । তখন তো আমি লাহোরে ছিলাম । আর বিকাল বেলা হত কি আমাদের পাকিস্তান বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলায় যে খবর হতো সে খবরগুলো ঢাকা থেকে যেতো। এ খবরগুলো শোনার জন্য,  যে কি বলতেছে এবং কি ধরনের আন্দোলন হচ্ছে, আমাদের হোস্টেলের কমনরুম একদম প্যাক্ট হয়ে যেতো পাকিস্তানী ছাত্রদের দিয়ে। তো ওরা আমাদের জিজ্ঞেস করত যে খবরে কি বলতেছে তোমরা ইংরেজিতে বা উর্দুতে আমাদেরকে একটু বলো। তো এগুলো বলতে গিয়ে আমাদের রক্ত আরো টগবগ করত, আরো খারাপ লাগত। তো শেষ পর্যন্ত যখন ২৫ শে মার্চ এর ঘটনা ঘটে তখন আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো এবং আমাকে নানা ভাবে অপমান করে। কিন্তু আমার পাঠান বন্ধুরা, আমার নেপালি বন্ধুরা আমাকে ওখান থেকে নিয়ে আসে এবং কলেজ এর অধ্যক্ষের কাছে আমরা যাই। তখন স্যার বললেন যে দেখো এটাতো জাতীয় সমস্যা এখন আমি কি করে তোমাদের প্রটেকশন দিব। তোমরা এক কাজ করতে পার হয় তোমরা তোমাদের আত্মীয় স্বজনদের বাড়ি চলে যাও নাহলে তোমরা সবাই বড় একটা রুমে এক জায়গায় থাকো।

চলনবিল প্রবাহঃ সে সময় আপনাদের কলেজে কতজন বাঙালি ছিলেন
ডা: সিরাজুল ইসলাম শিশিরঃ  আমরা ১২ জন বাঙালি ছিলাম। প্রত্যেক ক্লাসে ২ জন করে বাঙালি স্কলারশিপে আসত । ১০ জন স্কলারশিপে আসছিল আর ২ জন ইনটার্নশিপে ছিল। মোট ১২ জন বাঙালি ছিলাম কলেজের ছাত্র হিসেবে। বাকি তো পাকিস্তানের আমরা অংশ ছিলাম তাই অনেক বাঙালি লাহোরে থাকত। আমার বড় ভাইয়ের সবচেয়ে বেস্ট ফ্রেন্ড মেজর জিয়া। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমাদের যে মডেল স্কুল ঢাকাতে হয় ওইটার উনি প্রিন্সিপাল ছিলেন। আমি গিয়ে ভাইয়ের বাসায় থাকতাম।  পশ্চিম  পাকিস্তান গিয়ে আমি উনার বাসায় উঠলাম। উনি গিয়ে আমাকে ভর্তি করিয়েছিলেন। ছুটির দিনগুলোতে আমি উনার বাসায় যেতাম। কিন্তু ২৫ শে মার্চের পরে তো বাঙালি সেনাদেরকে ডিজলভড করা হয় এবং উনাদেরকে কনসেনট্রেটেড রাখা হয়। এজন্য অশান্তির সৃষ্টি হয় সবারই মনে। যেহেতু আমি পশ্চিম পাকিস্তান গভর্নর স্কলারশিপে গিয়েছিলাম গর্ভনর সাহেব আমার টিকেট এরেঞ্জ করে দেন এবং আমি সেই টিকিট নিয়ে পাকিস্তান আর্মির সাথে ১৮ ই এপ্রিল ঢাকায় ফিরে আসি।

চলনবিল প্রবাহঃ ঢাকায় ফিরে এসে আপনি কি গ্রামের বাড়িতে গেলেন নাকি ঢাকাতেই থাকলেন।

ডা: সিরাজুল ইসলাম শিশিরঃ  ঢাকায় যখন আসি তখন রাস্তায় কোনো গাড়ি-ঘোড়া ছিল না । একদম পুরো রাস্তা খালি। আমি এয়ারপোর্ট থেকে রিকশা নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির এপার্টমেন্টে যাই। কারণ আমার বড় ভাই সোহরাব হোসেন ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট প্রফেসর ছিলেন। উনার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলেন ড. আজিজুর রহমান। যার বাড়ি ছিল আত্রাই । আমি এসে উনাদের বাড়িতে উঠি । ওই সময় উনারা রাত্রে হসপিটালের কেবিনে  থাকতেন। আমি আর কাজের ছেলেটা বাসায় থাকতাম। ভাই আর ভাবি উনার বাচ্চাদের নিয়ে হসপিটাল এর কেবিনে  থাকতেন। ওখানে আমি ১৫ দিন আটকে যাই, তখন গ্রামে যাওয়ার পথ পাচ্ছি না । কারণ রাস্তা ঘাট খালি তখন। এর পর পাকিস্তান সরকার ঘোষণা দিল প্যাসেঞ্জার থাক না থাক গাড়ি চলতে হবে রাস্তায় । প্রথম দিন যখন গাড়ি চলে তখন বাসে উঠে আমি আরিচা ঘাট পর্যন্ত যাই। আরিচা ঘাটের একটু আগে আমাদের নামিয়ে দেয়। সেখান থেকে আমাদের বাড়ি যেতে দুই দিন লাগে। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে   পাকিস্তান আর্মির ক্যাম্পগুলোকে বর্জন করে বাড়ি পৌছাতে আমার দুই দিন লেগে যায়।

চলনবিল প্রবাহঃ যখন বাড়িতে গেলেন তখন ওখানে কি অবস্থা দেখতে পেলেন।
ডা: সিরাজুল ইসলাম শিশিরঃ যখন বাড়িতে গেলাম আমাদের অঞ্চলে তখন থমথমে ভাব বিরাজ করছিল। আমি পৌছার আগে আমাদের গুরুদাসপুরে পাকিস্তান আর্মি গিয়েছিল । সেখানে অনেকগুলো মানুষকে মেরে ফেলে তারা। আমার মা রাতে আমাদেরকে বাড়িতে ঘুমাতে দিতেন না। আমার পা ফুলে প্রথম কয়েকদিন আমি খুব অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম। ভাগ্যচক্রে হলো কি,  বাড়ি যাওয়ার সময়  আমি যখন পায়ে হাঁটা শুরু করলাম তখন আমার সাথে এক বিহারী ছেলে যোগ দিয়ে বলল, তুমি আমাকে বাঁচাও । আমার বাপ-মা সব রাজশাহীতে আমি বাড়ি পৌছাতে চাই। তো ওকে আমি বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর আমি তাকে বললাম ভাই এখন তো তোমাকে তোমার পথে যেতে হবে আমিতো আর রাজশাহী যেতে পারবো না। আল্লাহই জানে তার ভাগ্যে কি ঘটেছিল । তো বাড়িতে আমি কয়েকদিন রিকোভারি করলাম কিন্তু মা বাড়িতে ঘুমাতে দিতেন না। আমরা মাঠে গিয়ে ঘুমাতাম। তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ এর ভিপি ছিলেন আব্দুল কুদ্দুস ভাই। পরবর্তীতে তিনি এমপি হয়েছিলেন আমাদের ওখানের। আব্দুল কুদ্দুস ভাই আমাদের বাড়িতে থাকতেন । যার সুবাদে উনার সাথে আমাদের ভাইয়ের মত সর্ম্পক ছিল। আমি প্রত্যেক দিন সকালে বিকালে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে উনার বাড়িতে যেতাম। বলতাম ভাই চলেন যুদ্ধে যাই। ৬৫ সনে আমার পাকিস্তান আর্মির ট্রেনিং ছিল। ওই সময় পাকিস্তান ও ভারতের যুদ্ধ হয়েছিল । তখন আমি নবম শ্রেণিতে পড়ি । সেই সময় আমি মিলিটারি ট্রেনিং নিয়েছিলাম। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছিলাম যে আমি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিব। এদের বিরদ্ধে আমাকে যুদ্ধ করতে হবে, দেশকে মুক্ত করতেই হবে। কিন্তু আব্দুল কুদ্দুস ভাই এর পিছে পিছে ঘুরে কোনো লাভ হলো না, উনি যুদ্ধে গেলেন না। তখন আমার দুই বন্ধু ইউনুস ও আব্দুল জলিল আমার ক্লাসমেট । এদের দুই জনকে নিয়ে আমি ইন্ডিয়ায় যাওয়ার জন্য শুধু আমার মাকে বলে রওনা হয়েছিলাম। কিন্তু ছয় সাত মাইল যাওয়ার পরে ওরা দুই জন কান্না শুরু করে। বলে যে আমরা যুদ্ধ করতে পারব না। ওদের সাথে রাগ করে কথা বলা বন্ধ করে দিয়ে আবার বাড়িতে ফিরে আসলাম। দ্বিতীয়বার আমার দুলাভাইয়ের ধান-চালের ব্যবসা ছিল। তো উনি বললেন  আমি ধান কিনতে নওগাঁ এ যাচ্ছি তুই যাবি কিনা? আমি বললাম আমি যেতে পারি কিন্তু আপনি এটা কারো কাছে প্রকাশ করতে পারবেন না। কারণ মানুষ যদি জেনে যায় তাহলে আমি তো যেতে পারবো না। দুলাভাই এর সাথে আমি বেড়িয়ে গেলাম । কিছু দুর যাওয়ার পরে আমি ঠিক করলাম যে আমিও নৌকার গুণ টানব, যেভাবে হোক যাব। কিন্তু আমাদের শরীর ও চেহারা দেখে সব মানুষ সন্দেহ করে যে তুমি তো গুণ টানার ছেলে না, তুমি কোথায় যাচ্ছো?  এরকম করতে করতে যখন একান্ন বিঘা নামে যে জায়গা আছে ওখানে যখন পৌছি,  তখন দেখি আব্দুল জলিল ও ইউনুস আবার আসছে আমার পিছে পিছে। ওদের কে দেখে আমি আবার রেগে গেলাম। বললাম গতবার আমাদের থামাইছিস, তোরা আবার আসছিস। তো ওরা কসম খেয়ে বলল যে না আমরা আর তোর সাথে বিট্রে করব না । আমরা যাবো তোর সাথে। আমরা ভেবে রেখেছিলাম পত্নীতলা পৌছে আমরা যখন বর্ডার ক্রস করার জন্য চেষ্টা করব । ঠিক ওই সময় পাকিস্তান আর্মির ট্রাক ওখানে চলে আসে।  আর্মির ট্রাক যখন আসে তখন রাতের অন্ধকারে দৌড়াদৌড়ি করে পালাতে গিয়ে আমরা তিনজন আলাদা হয়ে যাই। আমরা ঝোপ ঝাড় যেখানে পেয়েছিলাম ওখানে লুকিয়ে ছিলাম। পরে ফিস ফিস করে ডেকে ডেকে তিনজন এক জাগায় হই এবং রাতের অন্ধকারে আমরা বর্ডার ক্রস করে ইন্ডিয়ায় প্রবেশ করি।

চলনবিল প্রবাহঃ ইন্ডিয়ায় গিয়ে আপনারা কোথায় গেলেন , কাদের সাথে দেখা করলেন।
ডা: সিরাজুল ইসলাম শিশিরঃ  ইন্ডিয়ায় প্রবেশ করে আমরা যাই পশ্চিম দিনাজপুরে। পশ্চিম দিনাজপুরের ওইখানে আমাদের আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি আব্দুল জলিল ভাইয়ের ক্যাম্প ছিল। আমরা ওই ক্যাম্পে গিয়ে বললাম যে আমরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে আসছি। আমি পূর্ব পাকিস্তান আসার পর আর দাঁড়ি কাটি নাই। আর আমরা যখন যাই তখন পাঞ্জাবি-পায়জামা পড়ে যাই। আমরা যখন ক্যাম্পে গেলাম উনি আমাদের কথা বার্তা শুনলেন। আমাদের কথা-বার্তা শুনার পরে উনি আমাদেরকে বললেন ঠিক আছে আপনারা পরে আসেন। উনি আমাদের নিলেন না । তখন আমরা অবাক হলাম , আমাদের মন খারাপ হয়ে গেল। আমরা যখন আসছিলাম তখন আমাদের খিদেও লেগেছিল। আমরা ভাবলাম একটা হোটেল পেলে কিছু খাব । তো ওই সময় একজন বয়স্ক মুরব্বী আমাদেরকে ডাকলেন। বললেন এই ছেলে তোমরা কি জয় বাংলার ছেলে। আমরা বললাম হ্যাঁ আমরা জয় বাংলার ছেলে। উনি বললেন তোমাদেরকে ক্যাম্পে নেয়নি ? আমরা বললাম, হ্যাঁ , আমরা ক্যাম্পে গিয়েছিলাম কিন্তু আমাদেরকে তো নিলেন না। পরে  উনি বললেন তোমাদের বাড়ি কোথায়? কার ছেলে? আব্বার নাম বললাম । উনি আমাকে বললেন তুমি আমাকে চেন না? আমি বললাম , চাচা আমি আপনাকে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। তো উনি বললেন আমি তোমার আব্বার কাছে পাটের ব্যবসা শিখে এখন পাটের ব্যবসা করি। চলো চলো ওটা তো আমার ছেলের ক্যাম্প, আমি নিয়ে যাচ্ছি তোমাদেরকে।

চলনবিল প্রবাহঃ যিনি আপনাকে এসব কথা বললেন তিনি আসলে কে ছিলেন।
ডা: সিরাজুল ইসলাম শিশিরঃ  উনি ছিলেন আব্দুল জলিল ভাইয়ের আব্বা । যখন উনি নিয়ে গিয়ে জলিল ভাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন তখন উনি জিজ্ঞেস করলেন নাম কি? কোথায় পড় ইতাদি । তখন সেই সুবাদে আমি বললাম আমার পাকিস্তান আর্মির ট্রেনিং আছে, আমি পাবনা জেলা স্কুলের বয় স্কাউট এর ট্রুপ লিডার ছিলাম। তো এই সমস্ত অভিজ্ঞতা শুনে বললেন আপনার তো অনেক অভিজ্ঞতা আছে তাহলে আপনি এদেরকে ট্রেনিং দেন। তখন তো কেবল পূর্বপাকিস্তান থেকে লোকজন ইন্ডিয়ায় ঢুকছে। এদেরকে অরগনাইজ করা বিরাট ঝামেলা ছিল। তখন আমি আস্তে আস্তে এদেরকে ট্রেনিং করানো শুরু করি এবং সবার সাথে পরিচিতি লাভ করি। সেখানে আমি প্রায় তিন মাস ছিলাম। ক্যাম্প কমান্ডার হিসেবে প্রশিক্ষণ দিতাম।

চলনবিল প্রবাহঃ এটা পশ্চিমবঙ্গের কোন জায়গা ছিল।
ডা: সিরাজুল ইসলাম শিশিরঃ  এটা ছিল পশ্চিম দিনাজপুরের বাঙ্গালিপুর। ওখানে আমাদের মরহুম বয়তুল্লাহ  সাহেব ওই ক্যাম্প এ থাকতেন, যিনি পরবর্তীতে স্পীকার  হয়েছিলেন। আব্দুল জলিল ভাইও ওখানেই থাকতেন। এইতো এভাবেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জীবন শুরু হলো।

চলনবিল প্রবাহঃ আমরা শুনেছি আপনি দেরাদূনে ট্রেনিং করেছেন , এটা কখন করলেন।
ডা: সিরাজুল ইসলাম শিশিরঃ  আমরা মে, জুন মাস পর্যন্ত ওখানে ছিলাম । এরপর জুলাই মাসে একটা গ্রুপ  আসে । যেহেতু আমি ক্যাম্প কমান্ডার ছিলাম উনারা এসে আমার সাথে কথা বলা শুরু করে। বলেন যে, আপনারা তো এখানে অনেক দিন ধরে আছেন , অনেক কষ্ট করছেন। চলেন একটু বেড়ায়ে নিয়ে আসি। তো আমি বললাম কোথায় বেড়াতে যাবো । উনি বললেন মালদহ, আমাদের সাথে গাড়ি আছে, আপনাদের বন্ধুদের ভেতরে যারা খুব ভালো তাদের মধ্যে থেকে আট দশ জন বাছাই করে আমাদের সাথে নেন। আমিতো ভাবছি,  সত্যি তো আমরা হতাশার মধ্যে পড়ে আছি। এর মধ্যে হঠাৎ এক রাতে ফ্ল্যাশ ফ্লাড হলো। আমরা সবাই পানির মধ্যে দাঁড়ায়ে ছিলাম । সেই রাতে খাবারও রান্না করা হয়নি। চিড়া বা মুড়ি যা পারছি রাতে খেয়েছি। অনেক কষ্ট ছিল। আর তখন ইন্ডিয়াও আমাদের ওভাবে সাহায্য করা শুরু করেনি। রিফুজিরা আসতে শুরু করেছে। তখন আমরা এই দশ জন ঠিক করলাম যে আমরা এই দশ জন যাবো। তো উনারা আমাদের ব্যাগগুলোও নিতে বললেন। তো আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না যে ব্যাগগুলো কেন নিতে বলছে । তো আমরা গাড়িতে উঠলাম। গাড়িতে উঠার পাঁচ-সাত মিনিট পর তারা বলল আপনাদেরকে এখন আমরা ইন্ডিয়ান আর্মির ট্রাকে উঠিয়ে দিবো। কোথায় যাচ্ছেন ও কেন যাচ্ছেন সেটা জিজ্ঞেস করতে পারবেন না। চুপচাপ বসে থাকবেন । আমাদের বড় বড় নেতাদের সঙ্গে আপনাদের সাক্ষাত করানো হবে। উনারা বলবেন আপনারা কোথায় যাচ্ছেন।  আমরা আসলে  বেড়াতে যাচ্ছি না মালদাতে। তো আমি যেহেতু পাকিস্তানে পড়তাম সেহেতু আমি উর্দু জানতাম । কিন্তু আমার সাথে এমনি গল্প করতেছিল। কিন্তু প্রশ্ন করা নিষেধ ছিল আগেই বলে দিয়েছিল। তো গল্প করতে করতে আমি ট্রাকের পাশ দিয়ে দেখতেছি যে জলপাইগুড়ি ছাড়লাম, এখন দেখাচ্ছে শিলিগুড়ি এত মাইল। শিলিগুড়ি এতদুর যে অনেক রাত হয়ে গেল। শিলিগুড়িতে গিয়ে আমাদেরকে একটা এয়ারফোর্স বেজ এর মধ্যে ঢুকানো হয় । সেখানে গিয়ে আমরা সিরাজুল আলম, তোফায়েল ভাই ও রাজ্জাক ভাই এর সাক্ষাত পাই । উনারা ওখানে আমাদের ব্যাখ্যা করেন যে, কেন আমরা এখানে এসেছি , কি প্ল্যান আসার । এবং বললেন তোমরা জানো যে এটা খুবই কষ্টের ট্রেনিং । এখান থেকে তোমাদেরকে বিমানে করে নিয়ে যাওয়া হবে ১৪ হাজার ফুট উপরে ক্যান্টনমেন্টে । সেখানে তোমাদের ট্রেনিং হবে । এখানে খুব কষ্ট পাহাড়ের ভিতর , এই সেই ইত্যাদি । তোমরা যারা ওখানে যেতে চাও না,  সেটা বললে তাদেরকে যার যার ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হবে। আর যদি যেতে চাও তাহলে তোমরা খাও, ঘুমাও, আরাম কর। তো পরের দিন আমাদেরকে এয়ারফোর্স এর ড্রেস দিল । সুতা ও সুই দিল । বলল কেটে কেটে তোমরা এগুলো সেলাই কর যেন তোমরা পড়তে পারো। আমরা এগুলো কেটে কেটে সেলাই করে পড়লাম। এরপর এসে উনারা ট্রেনিং এর বিষয়ে ব্যাখ্যা দিলেন । তিনি আরও একটা কথা বললেন, যেহেতু পৃথিবীর কেউই এখনও জানে না যে ভারতবর্ষ আমাদের ট্রেনিং দিচ্ছে তাই প্রত্যেকটা ছেলেকে একটা করে হিন্দু নাম নিতে হবে। সেজন্যে আমি নাম নেই শিশির ভাদুরী । দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমি আমার ডাক নাম হিসেবে শিশির ব্যবহার করি। যার বদৌলতে ঢাকা এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ এর বেশির ভাগ মানুষই আমাকে শিশির ভাই বলে জানে। আসল নাম কেউ জানে না ।
এ প্রসঙ্গে মজার একটা গল্প বলবো। আব্বা আসছেন মেডিকেল কলেজে আমাকে টাকা দিতে । হোস্টেলে এসে তো সিরাজকে   খুঁজতেছে। সবাইকে বলছে আমার ছেলে সিরাজ পড়ে এখানে। বেশির ভাগ ছাত্ররা তো সিরাজকে চেনে না। ছাত্ররা বলছে আপনি কাকে খুঁজছেন? আপনি কি লাহোরে যে পড়ছেন উনাকে খুঁজছেন ? উনার নাম তো শিশির ভাই। এখানে যে আমার নাম শিশির উনি তো জানেন না।

এরপর  আমরা দেরাদুনে যখন যাই  ওখানে আমাদের প্রশিক্ষণ হয় । ওখানে আমি কমান্ডার ছিলাম । স্কোয়াড লিডার ছিলাম। এটা গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ ছিল। গেরিলা যুদ্ধের কৌশল সমন্ধে আমাদের অনেক পড়াশোনা করতে হতো ও পরীক্ষা দিতে হতো। হাসানুল হক ইনু ভাই এখনো বেঁচে আছেন। আমরা একই সময় ট্রেনিং নিয়েছি । তারপর মাহবুব ভাই ছিলেন উনার সাথী। মাহবুব ভাই পরীক্ষায় ৩০ পেয়েছিলেন আর আমি ৩১ পাই । যার বদৌলতে কর্ণেল মালহোতরা , আমাদের ক্যাম্প কমান্ডার, উনি এসে আমাকে বললেন তুমি যেতে পারবে না। তুমি থাকবা এখানে, তুমি ইন্সট্রাক্টর হিসেবে এদেরকে ট্রেনিং দাও। কিন্তু পরবর্তীতে আমার বন্ধু ইউনুস ও জলিলের কান্নাকাটির কারণে উনি আমাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। পরে আমি ওদের সাথে দেশের ভেতরে চলে আসি। এখানে ট্রেনিং শেষ করে আবার আমাদের এয়ারফোর্স প্লেনে করে শিলিগুড়ির নিয়ে আসেন। আমরা আমাদের দেশে ঢুকবো । আমাদের সেল্টার ছিলো । প্রত্যেক রাতে ৬-৭ মাইল করে আমরা হাটতাম । পরে সেল্টারে গিয়ে সারাদিন আমরা ঘুমাতাম। যেহেতু আমাদের গন্তব্যে স্থানে পৌছাতে হবে । আমাদের গাইড ছিল । আমাদের গাইডরা আমাদের নিয়ে গেছেন । আমাদের শিলিগুড়ি থেকে আবার ওই বাঙালিপুরেনিয়ে আসছিল। তারপর বাঙালিপুর থেকে আমরা দেশের ভেতরে প্রবেশ করি ।

চলনবিল প্রবাহঃ তাহলে আপনি বাংলাদেশে প্রবেশ করলেন কোন মাসে
ডা: সিরাজুল ইসলাম শিশিরঃ  বাংলাদেশে আমরা আগস্ট মাসে প্রবেশ করলাম । আমাকে সাতজনের কমান্ডার দেওয়া হয়েছিল যে তুমি এদের লিডার হিসেবে দেশের ভিতরে যাবে । আমাদের অর্ডার ছিল যে হয় যুদ্ধ করে টিকে থাকবে না হলে শহীদ হবে। আমাদেরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল যে আমরা প্রশিক্ষণ দিয়ে যোদ্ধা তৈরি করব । যোদ্ধাদেরকে নিয়ে যখন হুকুম হবে তখন আমরা যুদ্ধ করব।

চলনবিল প্রবাহঃ দেশের ভিতর কোন কোন এলাকায় আপনারা অপারেশন পরিচালনা করলেন।
ডা: সিরাজুল ইসলাম শিশিরঃ  আমাদেরকে আবাদপুকুর এলাকা, গুয়াতা গ্রাম, নারায়ণ পাড়া এ সমস্ত এলাকার দায়িত্ব দেয়া হয়। আমার সাথে একটা ছেলে ছিল মোফাজ্জেল হোসেন তার নাম ।  আমরা প্রথমে ঢুকে এখান থেকে নৌকা করে বিলসাতে গিয়ে একত্রিত হই। এই এলাকায় থাকাটা আমরা নিরাপদ বলে মনি করলাম না। সেজন্য তখন আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলাম । মোফাজ্জল ভাই বললেন যে এই এলাকায় না থেকে আমার এলাকায় যাই। আমার এলাকায় পরিচিত লোকজন আছে ওইখানে থেকে আমরা কাজ করতে থাকি। তারপরে ভবিষ্যৎ এ দেখা যাক এখানে আসা যায় কিনা। তখন গুয়াটা গ্রামে আহমেদ চাচা,  উনার বিবি ও ছেলে ছিল । একটা ছোট ছিল , চার-পাঁচ বছর তখন ওর বয়স। তখন উনার ঘরের উপরে আমরা থাকতাম চালার নিচে । সেটি ছিল মাটির ঘর । চালার নিচে আহমেদ চাচা আমাদের থাকার জায়গা করে দেন, পেশাব এর জন্য জায়গা করে দেন, মই দিয়ে আমাদের ওঠার ব্যবস্থা করে দেন। আমরা যখন উপরে উঠে যেতাম তখন ভোরবেলা মইটা সরিয়ে আমাদের উপরে ওঠার ওই সুড়ঙ্গটা বন্ধ করে দিতেন। তখন কেউ বুঝতে পারতো না যে এখানে কেউ আছে কি না। তো সেখান থেকে আমরা রাত্রি ১০ টায় আবার নিচে আসতাম এবং গুয়াটা গ্রামে যে স্কুল ছিল ওই স্কুলের ভেতর আমাদের লোক ছিল । আমাদের মোফাজ্জল ভাইয়ের ছোট ভাই আফজাল ভাই খুবই জনপ্রিয় একজন মানুষ ছিলেন ওই এলাকার। আফজাল ভাই যেসব ছেলেগুলোকে নিয়ে আসতেন ওই ছেলেগুলোকে রাত্রি বেলা আমরা প্রশিক্ষণ দিতাম। আমাদের কাজ শুরু হয় এই গুয়াটা গ্রাম থেকেই।

চলনবিল প্রবাহঃ ওই সময় আমাদের চলনবিল বা গুরুদাসপুর এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা আর কে কে ছিলেন? 
ডা: সিরাজুল ইসলাম শিশিরঃ  আমার গ্রুপে  আমরা তিনজনই ছিলাম । আমি , আব্দুল জলিল ও ইউনুস। আর কেউ ওখানে ছিল না আমাদের সাথে। আমাদের কোনো হুকুম ছিল না যে আমরা নিজেদের প্রকাশ করি বা মানুষকে জানাই। গেরিলা যুদ্ধ হলো একটা গোপন যুদ্ধ, এটা হলো কৌশল এর যুদ্ধ । এটা অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ না,  এটা কৌশল খাঁটিয়ে যুদ্ধ করতে হয়। পরবর্তীতে আমার সব স্মৃতিতো ওখানেই রয়ে গেছে । এখনো শত শত মানুষ বেঁচে আছে তারা বলবে। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি যে কেউ বলতে পারবে না যে আমরা কোনো দূর্নীতি করেছি, অন্যায় করেছি, মানুষের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি। তাহলে তার জবাবদিহিতা এখনো আমি করতে রাজি। আমরা যখন ওখানে প্রকাশ্যে চলে গেলাম এবং ঘোষণাও দিয়ে দিয়েছিলাম যে আমার কোনো ছেলে যদি কোনো রকমের অন্যায় করে তাহলে আমি নিজে জনসম্মুখে তাদের বিচার করব। এদেরকে সেভাবে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলাম, সেভাবে তৈরি করেছিলাম, সেভাবে শিক্ষা দিয়েছিলাম । যার বদৌলতে ওখানে কয়েকটা ক্যাম্পে  কয়েকজন রাজাকারকে আমি সারেন্ডার করাই এবং তাদের  আমাদের সাথে মুক্তিযুদ্ধ করাই। অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর তিন মাস ওরা আমাদের সাথে যুদ্ধ করেছে। ওই সময় ওদের ট্রেনিং শেষ করে কোরআন শরীফ এর উপর আমার হাত রাখতাম, তার উপরে তার হাত রাখতাম, তার উপরে বুলেট রাখতাম এবং এখানে বলতাম যে শেখ মুজিবুর  রহমানের এর আদর্শে অনুপ্রাণিত থাকিব,  বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে যদি আমরা বিশ্বাসঘাতকতা করি তাহলে যেন এই বুলেটে মৃত্যু হয়। এরকদম কত শত বার কোরআন শরীফ এর উপর হাত রেখে শপথ নিয়েছি। যার কারণে আমি কোনোদিন বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কোনো কথা বলিনি। আমি জাসদের নেতা হতে পারতাম কারণ আমার উপর অনেক চাপ ছিল । কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না বলেই আমি কোনোদিন ওই নেতৃত্ব নেইনি, কোনো দায়িত্বও নেইনি।

চলনবিল প্রবাহঃডিসেম্বর বিজয়ের দিন আপনি কোথায় ছিলেন যেদিন বাংলাদেশ স্বাধীন হলো।
ডা: সিরাজুল ইসলাম শিশিরঃ  আগস্ট মাস থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত প্রায় ১৪০০ ছেলে আমার প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়ে যায়। আমরা ছোট খাটো অপারেশন করি বিভিন্ন জায়গায়তে এবং অক্টোবরের ভিতর ওই এলাকাগুলোকে মুক্ত করে ফেলি। অক্টোবরের পর থেকে আমরা অস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতাম। কিন্তু ছেলেরা সব অস্থির হয়ে গেছে যে আরো অস্ত্র আসছে না কেন। আমাদেরকে যারা ক্যাম্প থেকে ক্যাম্পে নিয়ে যেতো, শেল্টার থেকে শেল্টারে নিয়ে যেতো এদের মাধ্যমে আমাদের কাছে অস্ত্র পাঠানোর জন্য আমি একের পর এক চিঠি লিখতেছি, কিন্তু অস্ত্র আসতে ছিল না। তখন ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ছেলেরা একটা রেজুলেশন লিখে বলে যে আপনি ইন্ডিয়াতে যান, কেন আমাদের জন্য অস্ত্র কেন আসছে না, সেই বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। আমি তখন ৭ই ডিসেম্বর ইন্ডিয়াতে চলে যাই। ইন্ডিয়াতে গিয়ে আমি ক্যাম্পে গেলাম । ইন্ডিয়াতে যে অস্ত্র নাই,  অস্ত্র দিচ্ছে না। ইনু ভাই বললেন গাড়িতে ওঠ চল মালদা নিয়ে যাই। তো আমরা মালদা গেলাম। ওখানে আমাদের আশরাফ চাচা ছিলেন সিংড়ার এমপি। আশরাফ চাচার কাছেই গেলাম । আব্দুল জলিল ভাইও কিছুই বলছেন না , যে কেন অস্ত্র দিচ্ছে না। তখন আমাকে চাচার কাছে নিয়ে গেলেন । তো চাচাও কিছু বলতে পারলেন না। ওখান থেকে ইনু ভাই বললেন যে চল শিলিগুড়ি যাই । তখন ইনু ভাই একটা জিপ পেয়েছিলেন । ওই জিপে তিনি ঘোরাফেরা করতেন। আমাকে শিলিগুড়ি নিয়ে গেলেন।  আমাকে শিলিগুড়ি নিয়ে যাওয়ার পরে বলল যে শোন যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে । চল আমরা ফিরে যাই বাঙালিপুর। আমি বললাম বুঝলাম না যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে কেমন করে।  বলল যে ইন্ডিয়ান আর্মির সিদ্ধান্ত হয়েছে যে তারা বাংলাদেশের ভেতর ঢুকে পড়বে,  সেজন্য আমাদেরকে আর অস্ত্র দেবে না । তারা যেহেতু ওরা নিজেরাই ঢুকেছে। এজন্য আমরা ১৫ই ডিসেম্বর বাঙালিপুর ক্যাম্প এ ফিরে আসি। সেই রাত্রেই ইন্ডিয়ান আর্মি অ্যাটাক করল এবং মার্চ করে চলে গেল। আলহামদুলিল্লাহ আমরা ও ১৬ই ডিসেম্বর মার্চ করা শুরু করি ক্যাম্পে । কারণ এখন দেশ স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে, সবাই একটু ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছে ,  যে দেশের ভিতরে ঢুকবো বিজয়ের উল্লাসে ।  তখন ওই ক্যাম্প থেকে দলে দলে দেশের ভিতরে ঢোকা শুরু করে দিলাম।

চলনবিল প্রবাহঃ দেশ যখন স্বাধীন হলো সেই সময় এলাকার মানুষের মধ্যে কি অনুভূতি প্রত্যক্ষ  করলেন।
ডা: সিরাজুল ইসলাম শিশিরঃ  তখন আনন্দের ঢেউ পুরো দেশে। যাদেরকে আমি যুদ্ধ করব বলে নিয়েছিলাম তাদেরকে আমি যার যার বাড়ি পৌছে দিয়েছিলাম। দু-দিন ধরে আমি ছেলেগুলোকে তাদের বাড়িতে পৌছে দিয়েছি। যুদ্ধের জন্য আমার যে মেইন এলাকা ছিল আমি প্রতিটি মানুষের কাছে কৃতজ্ঞ ছিলাম। এখানে জনসভা করেছি এবং ভবিষ্যৎ এ দেশ গড়ার জন্য কি করতে হবে এদেরকে বুঝিয়ে তারপর আমি আমার গ্রামে খুবজীপুরে গিয়েছি। কিন্তু আমি একা যাইনি । একটা বিরাট বহর নিয়ে গেছি । এরা সবাই বলছিলো যে আপনার গ্রামে যাবো, দেখবো । যেহেতু ইউনুস এবং আব্দুল জলিলও ছিল আমাদের গ্রামের ,  সেজন্য আমরা কয়েকটা নৌকা ভর্তি করে একটা বহর নিয়ে চলে আসছিলাম গ্রামে। এখানে এসে আমি দেশ গড়ার অনেকগুলো কাজ করি।

চলনবিল প্রবাহঃ এরপর আমরা জানি আপনি আমেরিকায় চলে যান। তো ওখানে কোন প্রেক্ষাপটে গেলেন এবং কি করলেন। আমেরিকার জীবন  সম্পর্কে  যদি আমাদের কিছু বলেন।
ডা: সিরাজুল ইসলাম শিশিরঃ  দেশ স্বাধীন হবার পরে যখন আমি যখন হেঁটে হেঁটে বাড়িতে গিয়েছি তখন তো আমি ধ্বংস লীলা দেখেছি । আমার গ্রামে যখন আসলাম তখনও দেখেছি যে আমাদের হিন্দুপাড়া সম্পূর্ণ লুটেপুটে নিয়ে সরিষা বুনে দিয়েছে তাদের ভিটাতে। আমার অনেক বন্ধু ছিল যারা হিন্দু ছিল , আমার ক্লাসমেট। ভাগ্যক্রমে আমি যখন ইন্ডিয়াতে ঢুকি তখন ওরা রিফিউজি হিসেবে ইন্ডিয়াতে যাচ্ছিলো । সেই সময় ওদের সাথে দেখা হয়। আমি দুইশো টাকা নিয়ে বেড়িয়েছিলাম । ওই টাকা দিয়ে চাল কিনে একটা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ইন্ডিয়াতে যখন আমি প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলাম তখন ওদেরকে খুঁজে পেয়েছিলাম কাছাকাছি । তখন আমি ওদের কাছে গিয়েছিলাম। দেশের ভেতর প্রবেশ করে কি করতে হবে আমিতো জানি । আমি একজন গেরিলা যোদ্ধা , দেশ গঠন এখন আমার মুখ্য উদ্দেশ্য। আমি এসেই খুবজীপুর স্কুল মাঠে একটা জনসভা করি।
সে জনসভায় সব মানুষকে ডাকা হয়েছিল । তাদেরকে আমি বলি, হিন্দুর যদি কোনো সম্পত্তি যদি আমি কারোর বাড়িতে পাই তাদেরকে আমি কঠিন শাস্তি দেব । প্রত্যেক মানুষকে আমরা প্রকাশ্যে বলেছিলাম এটা । কিন্তু তারা যদি লুন্ঠিত জিনিসগুলো ফেরত দেয় এবং তারা যদি তাদের বাড়ি ঘর তৈরি করে দেয় তাহলে আমি তাদেরকে মাফ করে দিব। রাজাকার এবং শান্তি কমিটির যারা ছিল তাদের জন্য আমার ইন্সট্রাকশন ছিল,  তাদের  মারলেও মেরে ফেলিস না, তোরা এদেরকে বাঁচিয়ে রাখবি। পরে  এদেরকে আমি আলাদা ভাবে ডাকলাম । ডেকে বললাম কি করব বলো , তোমরা বাচঁতে চাও নাকি মেরে ফেলব। তো মানুষ তো সবাই বাচঁতেই চায় । তখন আমি বললাম যে একটা শর্তে মাফ করতে পারি যে,  হিন্দুদের প্রত্যেকটা গ্রাম তোমরা গঠন করবে, মেরামত করে দিবে । প্রত্যেকটা কাজ তোমরা সুপারভাইজ করবে। ওদেরকে লাগিয়ে দিলাম । আমার ১০০ ভাগ বাড়ি তৈরি হয়ে গেল।  যে বাড়িতে কোনোদিন টিনের ঘর ছিল না সে বাড়িতে এখন টিনের ঘর দেখা যাচ্ছে। ওখানে গিয়ে দেখলাম প্রত্যেকটা বাড়ি লেপে-টেপে সুন্দর ঝকঝকা করে দিয়েছে। এরপর আমি বড়লোকদের কাছ থেকে ২০০ টাকা চাঁদা নেই। চাঁদা নিয়ে হাড়ি-পাতিল, প্লেট,গ্লাস, জগ এগুলো সব কিনে রেডি করলাম। নিজ বাড়িতে যখন পালিয়ে যাওয়া লোকজন যখন আসবে এগুলো তাদের মাঝে দিয়ে দিব। আরেকটা কাজ আমি করেছিলাম । তাদের যত জমি ছিল, এই জমিতে চাষ করার জন্য আমি এলাকার ট্রাক্টরগুলো সিজ করি । এরপর গোডাউন থেকে  গম আর চীনার বীজ মাঠে ছড়ানোর ব্যবস্থা করি। ট্রাক্টর দিয়ে চাষ করে গম এবং চীনা আমি প্রত্যেকের জমিতে বুনে দেই। এগুলো করার পর মেডিকেল কলেজ খুলে গেলে আমি মেডিকেল কলেজে ফিরে গেলাম। লাহোরে ফেরার কোনো পথ নাই। আমি ঢাকা কলেজের  ভালো ছাত্র ছিলাম। সেই সুবাদে আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলাম। এরপরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদ এর জেনারেল সেক্রেটারি হলাম।

চলনবিল প্রবাহঃ তখন কি কোনো দলীয় ব্যানারে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হত?
ডা: সিরাজুল ইসলাম শিশিরঃ  আমাদের একটা নিউট্রাল সংগঠন ছিল মেধাবী ছাত্রদের নিয়ে । এর নাম ছিল অগ্রগামী। শেখ কামাল এসে আমার জন্য ক্যাম্পেইন  করত। সবাইকে বলত শুধু তোরা জেনারেল সেক্রেটারি পদে শিশিরকে ভোট দিবি বাকি সব ভোট ছাত্রলীগকে দিবি। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের পর অভিষেক অনুষ্ঠানে আমি যে টাকা পেলাম সে টাকা দিয়ে দুই হাজার গাছ কিনলাম। গাছ কিনে মেডিকেল এবং হোস্টেল চত্বরে সব গাছ লাগালাম। কিন্তু অভিষেক অনুষ্ঠানে আমি আমার বক্তব্যে কিছু কথা বলেছিলাম যার জন্যে ওই সময়ের যারা নেতা ছিলেন তারা আমার উপর ক্ষেপে গেলেন। অভিষেক এর তিনদিন পরে আমাকে আক্রমণ করা হয়, মারধর করা হয় । একটা ফ্র্যাক্চার হয়েছিল । এটার পরে যে ভাল কাজই করতে যাই তাতেই বাধা আসতে লাগল। যে দুই হাজার গাছ লাগিয়েছিলাম সেটা তারা তুলে ফেলে । তারা বলে,  মানুষের রক্তে শ্লোগান লেখার কথা আপনি বাগান বানাচ্ছেন। আমি বললাম না আমি গঠনে বিশ্বাস করি , আমি ধ্বংসে বিশ্বাস করি না। আমি এটা করব । কিন্তু আমি এটা করতে  পারি না । ওদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমি হেরে যাই। তখন মন খারাপ করে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে এদেশে থাকবো না। যেহেতু ভাই আমেরিকাতে ছিলেন, ভাই আমার জন্যে দরখাস্ত করেন । আমি ইমিগ্রেশন পেয়ে পাশ করার দুই বছর পর আমি আমেরিকাতে চলে যাই।

চলনবিল প্রবাহঃ ওখানে গিয়ে আপনি কত দিন থাকলেন আমেরিকাতে। আমেরিকার কর্মজীবন সম্পর্কে   যদি কিছু বলেন।
ডা: সিরাজুল ইসলাম শিশিরঃ  আমেরিকাতে আমাদের ডাক্তারি জীবন অনেক লম্বা জীবন। ওখানে গিয়ে পরীক্ষা দিলাম । ওদের পরীক্ষায় পাশ করলাম । পাশ করার পরে সেশন শুরু হয় জুলাইতে। আমি জুনে  পরীক্ষা দিয়ে পাশ করলাম। সেশন শুরু হবে পরের বছর জুলাইতে। ওখানে আমি ইন্টার্নশিপ করার জন্য  ফিলাডেলফিয়া  শহরে যাই,  যেখানে আমার বড় ভাই থাকেন। ওখান থেকে ইন্টার্নশিপ শেষ করে আমি মেডিসিনে স্পেশালটি করতে যাই ব্রুকলিন হসপিটাল নিউইয়র্কে। নিউইয়র্কে আমি ছয় বছর ছিলাম। আমার রেসিডেন্সি শেষ করি মেডিসিনে, স্পেশালিস্ট হলাম মেডিসিনে। তারপর এক বছর আমি চিফ রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করি। এরপর আমার ডিরেক্টর বলল যে, তুমি গ্যাস্ট্রোএন্টালজিস্ট হও। আমি কার্ডিওলজিস্ট হতে চেয়েছিলাম কিন্তু উনি হতে দিলেন না। বললেন ১৪০% কার্ডিওলজিস্ট আছে দেশে। তো আমি বললাম আমি এখন কি করব। তো উনি বললেন যে তুমি গ্যাস্ট্রোএন্টালজিস্ট  হও। তখন আমি বললাম যে আমি একটা জায়গায়ও দরখাস্ত করিনি। তখন উনি ডিরেক্টরকে ফোন করলেন গ্যাস্ট্রোএন্টালজিস্ট ড. মরিস সিরিউলিকে ।  বললেন,  সিরিউলি তুমি কাউকে সাইন করেছো কিনা। উনি বললেন না এখনো করিনি। তো উনি বললেন আমি ইসলামকে পাঠাচ্ছি ওকে কন্ট্রাক্ট দিয়ে দাও। আমাকে ওখানে ইসলাম বলে চিনে সবাই। আমি যেয়ে কন্ট্রাক্ট সই করলাম। আমি কোনোদিন দরখাস্ত করিনি গ্যাস্ট্রোএন্টালজিস্ট ফেলোশিপ এর জন্য। ওখান থেকে আমার জীবন আবার নতুন মোড় নিল। আমার ডিরেক্টর মার্টিন বনভেন্ট্রি আমাকে খুবই ভালোবাসতেন। স্যারের কাছেই আমি ফেলোশিপ করলাম। এরপর ফেলোশিপ কমপ্লিট করে আমি তবলিগ জামাতে চলে যাই। আমার তবলিগ জামাতে গিয়ে আর মনে হচ্ছিল না যে আমি আর দুনিয়ার জীবনে ফিরে যাই। কিন্তু কাকরাইলের মুরব্বীরা বললেন না তোমাকে যেতে হবে। তুমি ডাক্তারি ছেড়ে যদি তবলীগ কর , তাহলে মানুষ ভাববে যে তবলীগ করতে হলে ডাক্তারী ছেড়ে দিতে হবে। বললেন তুমি ডাক্তারিও করো , সাথে সাথে তবলীগও কর।  ওখানে গিয়ে আমি ফ্লোরিডায় চলে যাই। ফ্লোরিডায় বাংলাদেশের মত আবহাওয়া, একই রকম গাছপালা । আর আমি ঠান্ডা পছন্দ করতাম না তাই আমি নিউইর্য়ক ছেড়ে আমি ফ্লোরিডায় যাই। এবং গত ৩৫ বছর ফ্লোরিডায় গিয়ে আমি প্র্যাকটিস করেছি । আল্লাহ  তায়ালা এই দুনিয়াতে যা কিছু করার তৌফিক আমাকে দিয়েছেন আমার এই ফ্লোরিডার জীবন থেকেই আমাকে এই তৌফিক দান করেছেন।

চলনবিল প্রবাহঃ আমরা জেনেছি আপনি আমেরিকা থেকে স্থায়ী ভাবে চলে আসছেন এখন বাংলাদেশে থাকবেন বলে স্থির করেছেন তো এটার কারণ কি এবং দেশে কি করতে চান?
ডা: সিরাজুল ইসলাম শিশিরঃ  আসলে বর্তমান পৃথিবী স্থায়ী অস্থায়ী পৃথিবী না। আজকে সকালে আমার ইচ্ছা হল হংকং চলে গেলাম, বিকালে ইচ্ছ হলো আমি টোকিওতে গেলাম। দুনিয়াটা এতো ছোট হয়ে গেছে যে আগে আমরা ঢাকায় আসার স্বপ্ন দেখতাম। গ্রামে থেকে এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন ছিল। আজকে সেই স্বপ্নও নাই। আজকে আল্লাহ  তায়ালা যাদেরকে সামর্থ দিয়েছেন তারা দুনিয়ার যেখানে ইচ্ছা সেখানে যেতে পারে থাকতে পারে। আলহামদুলিল্লাহ ,  আমার চারটা ছেলে-মেয়ে । ওরা বড় হয়ে গেছে। তারা চাকরি জীবনে চলে গেছে । তারা ছড়ানো ছিটানো আছে আমেরিকাতে। কখনো আমি ছেলেদের দেখতে যাই , কখনো মেয়েদের দেখতে যাই। এখন যেখানেই থাকি একলা থাকা আরকি । এখনতো ভিডিও কলে প্রত্যেকদিন আমার নাতিদের সাথে গল্প করি। ওরা দুষ্টমি করে।

আর একটি বিষয় জানিনা এগুলো মানুষকে বলা ঠিক হয় কিনা। আমি যা কিছু উপার্জন করেছি বাংলাদেশের মানুষের জন্য ব্যয় করেছি। আমার স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশ, যুদ্ধ করেছি বাংলাদেশের জন্য। তো শেষ জীবনে ইচ্ছা হলো দেশের মাটি যদি ভাগ্যে থাকে ওখানেই ঘুমাই। মায়ের কবরের পাশে যেন আমার কবরটা হয়। কিন্তু আল্লাহ  ছাড়া তো কেউ জানেন না যে আমাদের মৃত্যু কোথায় হবে। আমি ২০১৯ সালে অবসর গ্রহণ করি করোনা শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে। আমেরিকাতে আল্লাহ  তায়ালা আমাকে অনেক কিছু করার তৌফিক দিয়েছেন। ভাবলাম এগুলোতো এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। আমি অরল্যান্ডে যখন যাই তখন একটা মাত্র মসজিদ ছিল । এখন ৩৮ টা মসজিদ সেখানে। ৩ টা মুসলমানদের হাই স্কুল, ৩টা কবরস্থান, আমাদের তবলিগের মারকাজ। যা যেখানে আল্লাহ  আমাকে ব্যবহার করেছেন আমি অংশগ্রহণ করেছি। দেশের জন্যেও কক্সবাজারে আমাদের হোপ ফাউন্ডেশন আছে। এটা ১৯৯৯ সাল থেকে আছে। এটা একটা ছোট্ট প্রতিষ্ঠান ছিল। এখন ৪ টা হসপিটাল সেখানে ১২০০ ডাক্তার কর্মচারী কাজ করেন, আমাদের প্রায় ৪৬টা ক্লিনিক আছে সেখানে। হোপ ফাউন্ডেশন এর সাথে আমি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম। দেশেও কয়েকটা স্কুল-মাদ্রাসা করার তৌফিক দিয়েছেন আল্লাহ  তায়ালা। এগুলো ছিল আমার পেশার বাহিরে । কিন্তু ডাক্তারী বিদ্যায় আমাকে কিছু করতে হবে এই চিন্তা কাজ করে । মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমার পরিচয় হয় প্রায় ২৭ বছর আগে। উনার চিকিৎসার সাথে আমি ওতপ্রোতভাবে ভাবে জড়িত। উনি আমাকে খুবই স্নেহ করেন, ভালোবাসেন। চিকিৎসার দিক থেকেও উনি আমার মতামত নেন । আমি সক্রিয় ভাবে উনার চিকিৎসা করেছি। উনিও জানেন যে আমি দেশের জন্যে কি করতেছি । কোনোদিন সরকারের কোনো টাকা পয়সা নিই নি, মানুষেরও কোনো টাকাপয়সা নিইনি। আল্লাহ তায়ালা আমাকে যা সামর্থ্য দিয়েছেন, আমি নিজের পকেটের টাকা খরচ করে এগুলো করার চেষ্টা করেছি। এজন্য এখন শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার  ইন্সটিটিউট এবং হসপিটাল নিয়ে আপার সাথে ফ্লোরিডাতে আলোচনা করেছিলাম। আপা বলেছিলেন ২০০৮ এর ইলেকশনে আমি যদি আবার নির্বাচিত হই তাহলে আপনার এ হসপিটাল করে দিব। যারা সিনিয়র ডাক্তার আছেন বিশেষ করে প্রফেসর আজাদ খান ও মাহমুদ হাসান স্যার,  উনাদের সাথে তখন আমার পরিচয় ছিল না । আপা যখন বললেন এই প্রতিষ্ঠান করা হবে তখন আমি উনাদের সাথে যোগাযোগ করলাম। যেহেতু আমি দেশে থাকতাম না পুরো টাইমটাতো উনাদের সহযোগিতা, উনাদের নেতৃত্বে শেখ রাসেল প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। দেশের মানুষ এখন খুব ভালো গ্যাস্ট্রোএন্টালোজির চিকিৎসা পাচ্ছে এখানে। এই হসপিটালকে আরো বড় করার জন্য আমি এখন পুরোপুরি কাজ করছি। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন আনার জন্য কাজ করছি। আমাদের নেত্রী আমাকে যখন যেটা বলেন আমি সেভাবে সেগুলো নিয়ে কাজ করছি। আমি নিজের প্রচার পছন্দ করি না । তাই আমি উনাকে সবসময় বলি যে আমি পর্দার আড়াল থেকে করতে চাই। আমি নাম চাই না বা আমি ক্রেডিট নিতে চাই না। এভাবে আমি কাজ করছি এবং যত দিন বেঁচে আছি , সুস্থ আছি আল্লাহ  তায়ালা তৌফিক দিলে আমি এগুলোই করে দেশে সময় কাটাবো। কিন্তু আমার ছেলে মেয়ে, নাতি পুতি তো সব ওই দেশে। ওদেরকেও সময় দিতে হয় বা যখন ডাক আসে আমি চলে যাই । একবারে চলে আসছি এ কথাটা শুনতে একটু খারাপ লাগে । আর আমার ছোট মেয়ে ওর মন সবচেয়ে বেশি খারাপ ছিল যখন ও শুনে যে আমি দেশে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখন ও বড় হয়েছে কিছুটা বোঝে।

চলনবিল প্রবাহঃ আমরা দেখছি যে আপনি এলডারলি-কেয়ার বাংলাদেশ নামে যে প্রবীণদের  যে সংগঠন আছে সেটা নিয়ে কাজ করছেন। এটার সাথে সম্পৃক্ত হওয়া বা এটাকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যেতে চান?
ডা: সিরাজুল ইসলাম শিশিরঃ  এলডারলি কেয়ার আমি মনে করি বাংলাদেশ এর মানুষের জন্য একটা নতুন সূর্যোদয়ের মত। এই জিনিসটি যদি আমরা, প্রতিটি গ্রামে যারা গঠনমূলক কাজ করে, যারা জনসেবার উদ্যোক্তা  এবং নওজোয়ানদের পাশে নিয়ে এক একটা ইউনিট করতে পারি তাহলে আমাদের যে শ্লোগান,  আমাদের মধ্যে ৬০ বছরের উর্দ্ধে যাদের বয়স তাদের কাউকে আমরা বিনা চিকিৎসায় মরতে দেব না। আমরা সরকার থেকে কোনো টাকা পাই না। মানুষ আমাদের টাকা দেয়, নিজেরা আমরা টাকা দেই, যাকাতের পয়সা দিয়ে মানুষের চিকিৎসা দেওয়া হয়। আমাদের এলাকায় ছানি পড়া আর মানুষ নাই। যাদের ছানি ছিল আমরা তাদের সবাইকে নিয়ে অপারেশন করেছি। যার যে ধরনের চিকিৎসা দরকার আমাদের ভলেন্টিয়াররা তাদেরকে সে ধরনের চিকিৎস দেয়। টাকা পয়সা আমরা সবসময় কালেক্ট করছি , মানুষ পাঠায়। আমরাতো অনেক সময় চিনিও না যে কোথা থেকে টাকা আসছে। যেমন বরিশাল থেকে একজন টাকা পাঠাচ্ছেন। এরকম করে আমাদের একটা পজিটিভ ফান্ড তৈরি হয়েছে। এই আইডিয়াটাকে বা প্ল্যানটাকে আমরা পুরো বাংলাদেশের মানুষের কাছে ছড়িতে দিতে চাই। বাংলাদেশ সরকারের কাছে আমরা অ্যাপ্লিকেশন সাবমিট করেছি । রেজিস্ট্রেশন পেলে আমরা এটা নিয়ে দেশব্যাপী প্রচারণায়  নামব। এটা আমাদের এডিশনাল সেক্রেটারি ( স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়) সাইদুর রহমান সাহেবের মস্তিষ্কে আল্লাহ  তায়ালা এই আইডিয়াটা দিয়েছিল এবং কোনো এক কারণে এই গোনাহগারকে তারা এটার অংশ বানিয়েছিল।

চলনবিল প্রবাহঃ আমরা একটু শেষের দিকে যেতে যাই। শেষ একটা প্রশ্ন করতে চাই আপনাকে। আপনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। যে স্বপ্ন প্রত্যাশা নিয়ে এদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ করেছিল , যে সমৃদ্ধ সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিল সেটার কোন পর্যায়ে আমরা যেতে পেরেছি। পরিশেষে আমাদের নতুন প্রজন্মকে যদি আপনার কিছু বলার থাকে
ডা: সিরাজুল ইসলাম শিশিরঃ  আমি মুক্তিযুদ্ধ করার পরে দেশ গঠনের জন্য  আমি ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গিয়েছিলাম । কিন্তু প্রতিটা ক্ষেত্রে আমি বাধাগ্রস্ত হই । হতাশা এবং বিরক্ত হয়ে আমি দেশ ত্যাগ করেছিলাম। যদিও তখন আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে দেশের জন্য যতটুকু পারি করেছি। আমি সবসময় বিশ্বাস করতাম এবং আমার বক্তৃতায় বলতাম যে আমি একজন ডাক্তার হয়ে একটা পাড়ার বা একটা অঞ্চলের মানুষের সেবা করতে পারি। কিন্তু আমি যদি একজন নেতা হতে পারি বা আমার যে স্বপ্ন সে স্বপ্ন যদি মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিতে পারি তাহলে পুরো দেশ তথা বিশ্বের জন্য একটা অবদান রেখে এই দুনিয়া থেকে যেতে পারি । কিন্তু যখন আমি ওটা পারলাম না তখন আমি বিদেশে চলে যাই। এরপরে আমার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে পরিচয় ঘটে এবং উনার বিভিন্ন আইডিয়া ও কাজকর্ম দেখে আশাবাদী হই যে একদিন না একদিন এই দেশ সোনার বাংলায় পরিণত হবে। বঙ্গবন্ধুর যে স্বপ্ন আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল মুক্তিযুদ্ধ করতে, সেই স্বপ্ন উনি বাস্তবায়িত করে যেতে পারেননি। কিন্তু উনিতো শুরুটা করেছিলেন । কিন্তু যে জাতির ভিতরে মীরজাফরের রক্ত আছে, মোশতাকের রক্ত আছে সে বিশ্বাসঘাতক জাতির জন্য কোনো কাজ করতে যাওয়া খুবই কঠিন। যেটা সবসময় আমি আমার বক্তৃতায় বলি, পাকিস্তানীরাও আমাদের লুটেপুটে খেয়েছে , এই দূর্নীতিবাজ মানুষগুলোও এদেশকে লুটেপুটে খাচ্ছে । আমরা তো যুদ্ধ করিনি তার জন্যে , যে দেশ স্বাধীন হলে তারা সেই দেশকে লুটেপুটে খাবে। কিন্তু একজন মানুষ হলেও তো আছে, যার নেতৃত্বে এই বাংলাদেশ পৃথিবীতে রোল মডেল হয়ে গেছে। মীরজাফরদের কাছে রোল মডেল হয়নি, যারা বাংলাদেশের দুশমন, স্বাধীনতা বিরোধী তাদের কাছে বাংলাদেশ রোল মডেল না। কিন্তু সমস্ত পৃথিবীর কাছে রোল মডেল । কালকে না পরশু নিউজ ছিল যে অর্থনৈতিক দিক থেকে আমরা কোন দেশ হতে যাচ্ছি। মাস্টারকার্ড ইভেলুয়েশনে বলছে যে বাংলাদেশের ইকোনোমি কোথায় যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতিটি আনাচে-কানাচে আজকে উন্নতি হচ্ছে। তো এটা যদি আমাকে উৎসাহিত না করে, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাহলে আমরা কিসের জন্যে দেশ স্বাধীন করেছিলাম। আমিও একদিন ক্ষমতা হাতে পাবো, আমিও লুটেপুটে খাবো এদেশকে, সেজন্যে কোনো মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ করে নাই। আমার ১৪০০ ছেলে ছিল গ্রামে-গঞ্জে, ওদের নাম কে জানে। ওরা সার্টিফিকেট পায়নি, ওরা ভাতা পাচ্ছে কি পাচ্ছে না কে জানে। আমিতো সার্টিফিকেট নিয়েছিলাম না । আমাকে তো সার্টিফিকেট পাঠিয়ে দিয়েছিল দুই না তিন বছর আগে। আমিতো কোনো ফরম ফিলআপও করিনি।  কারণ আমি চেয়েছিলাম যে আমার প্রতিটা ছেলে যখন সার্টিফিকেট পাবে, ভাতা পাবে তখন আমি নিব। আমি যেদিন ভাতা উঠাতে গিয়েছিলাম সেদিন আমি সাইনও করতে পারছিলাম না। আমার হাত এতো কাঁপতেছিল। আমার কোনো ছেলে যদি ভাতা না পায় তাহলে আমি কি জবাব দিব। সেজন্য আমি টাকা তুলে সাথে সাথে সব ডিস্ট্রিবিউট করে দিয়েছি। যে সমস্ত মুক্তিযোদ্ধারা মারা গেছে, শহীদ হয়েছে তাদের পরিবারের পিছনে আমি সব টাকা দিয়ে দিয়েছি।
যে সোনার বাংলার স্বপ্ন নিয়ে আমরা দেশ স্বাধীন করেছিলাম সেই সোনার বাংলার রূপরেখা আমরা দেখছি। আমার অনুরোধ থাকবে যে যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা আছেন এবং যারা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন এই ইলেকশান যেন বাংলাদেশের দুশমনের হাতে যেন না চলে যায়। শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করার জন্য, তার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য বঙ্গবন্ধুর  স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার জন্য আমরা সবাই যেন কাজ করি। যে উদ্দেশ্যে নিয়ে আমরা দেশ স্বাধীন করেছিলাম সেই দেশ কিছুটা হলেও যেন আমরা মৃত্যুর আগে দেখে যেতে পারি। তাহলেই আমাদের দেশ, আমাদের আত্মা শান্তি পাবে। যারা যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছেন, বঙ্গবন্ধু ও তাদের পরিবারের যারা এদেশের জন্যে জীবন দিয়ে গেছেন তাদের আত্মা শান্তিতে থাকবে । এই কামনা করে আমি সবার প্রতি আহবান জানাচ্ছি যে , চলুন আমরা সবাই মিলে সোনার বাংলাদেশ গড়ার জন্য কাজ করি।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।

চলনবিল প্রবাহঃ আপনাকে ধন্যবাদ
ডা: সিরাজুল ইসলাম শিশিরঃ  চলনবিল প্রবাহকেও ধন্যবাদ।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..

সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত