1. chalanbeel.probaho@gmail.com : News :
  2. khokanhaque.du@gmail.com : khokan :
মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:৩৫ অপরাহ্ন

দখল-দূষণে অস্তিত্ব সংকট
শুনতে কি পাও চলনবিলের অব্যক্ত কান্না !

আবুল কালাম আজাদ
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০২৩
  • ৫৩৩ বার পঠিত

নদী আর প্রমত্ত  চলনবিল মানুষের বর্বর নির্যাতনে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। ও মানুষ,শুনতে কী পাও,নদী আর চলনবিলের কান্না? বড়াল-আত্রাই-নন্দকুঁজা-গুমানি নদীই হচ্ছে উপমহাদেশের বিখ্যাত ঐতিহাসিক চলনবিলের প্রাণ ।এই ’চলনবিল’কে বাঁচাতে হলে সবার আগে বাঁচাতে হবে চলনবিলের প্রাণ সঞ্চালনকারি বড়াল-নন্দকুঁজা-আত্রাই -গুমানি এবং শাখা- উপ শাখা নদী ,খাল  -জলাশয়কে। নাব্যতা ফিরিয়ে বাড়াতে হবে পানির প্রবাহ। আমরা কী পারিনা নদী আর চলনবিলকে বাঁচাতে? উন্নয়নের নামে নদ-নদী,খাল-জলাশয় দখল-দুষণ নির্যাতনে নদ-নদীর নব্যতা ও অস্তিত্ব হারিয়ে গুমরে গুমরে ভাষাহীন কান্না করছে। নদ-নদীর প্রবাহ না থাকায় উপমহাদেশের বিশাল জলাভূমি চলনবিলও পানিশুণ্য মরুময়। হারিয়ে গেছে মাছ-পাখি,জলজ সম্পদ।পাল্টে গেছে জলবায়ু, পরিবেশ এবং মানুষের জীবনযাত্রা।ঝুঁকিতে চলনবিলের মানুষ- পরিবেশ।

নদী না বাঁচলে মানুষ বাঁচবেনা। তাই মানুষের জীবন রক্ষার্থেই নদীর জীবন বাঁচাতে হবে। বলা হয় নদীর সাথে জীবনের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। পরিবেশবাদীরা বলছেন, নদী না বাঁচলে চলনবিল, হাওর-বাওর ও পরিবেশ বাঁচবেনা। আর পরিবেশ না বাঁচলে মানুষ, প্রাণি , জীববৈচিত্র বাঁচবেনা। তাইতো নদীকে বাঁচাতে নানা প্রক্রিয়ায় চলছে আন্দোলন । গড়ে উঠেছে শত  সংগঠন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৪ ডিসেম্বর সোমবার  ঢাকার চার পাশের নদীগুলোর নব্যতা রক্ষা ও দুষণ রোধে প্রণীত মহা পরিকল্পনার আলোকে সমীক্ষা প্রতিবেদন উপস্থাপন এবং সংশ্লিষ্ট প্রকল্প গ্রহণের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে এক সভায় বলেন,’ দেশকে রক্ষ করতে হলে নদীগুলোকে রক্ষা করতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’ আমরা যদি বাংলাদেশকে রক্ষা করতে চাই তাহলে আমাদের নদীগুলোকে বাঁচাতে হবে’।এছাড়াও তিনি নদ-নদী সুরক্ষায় কঠোর দিকনির্দেশনা দেন। (দৈনিক মানব জমিন,ভোরের ডাক,সময়ের আলো, প্রথম আলো সহ বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত-৫/১২/২০২৩) ।

মানব সভ্যতার উন্নয়ন, জীববৈচিত্র এবং পরিবেশই গড়ে উঠেছে নদী কেন্দ্রিক । ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় , পৃথিবীতে যত সভ্যতা তার সবই গড়ে উঠেছে নদীর তীরে। ব্যবসা-বাণিজ্য, শহর, নগর সবই নদীর অবদান। মানুষের আর্থ-সামাজিক, জীব বৈচিত্র, পরিবেশ, জলবায়ূ , কৃষি-শিক্ষা সবকিছুর মুলে নদী। দিনে দিনে মানুষ নিজের স্বার্থে নদীর দুই কুলে জেগে ওঠা সিকস্তি-পয়স্থি ভূমি বিভিন্ন সময়ের সরকার  ভূমি খেকো প্রভাবশালী, রাজনৈতিক নেতারা বেপরোয়া ভাবে দখল-দুষণ আর নির্যাতন করে নদীর টুটি টিপে মেরে ফেলছে। নদীর সাথে মেরে ফেলেছে ঐতিহাসিক ’চলনবিল’কে। কোন বাধাই মানছেনা। আর এর  সাথে  জড়িত অসাধু ভুমি অফিসের কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালীরা।

নদী ও নারী নির্যাতন সমানভাবে চলছে। এই নির্যাতন থেকে নদীর জীবনী সত্বাকে রক্ষা করতে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন(বাপা), বেলা, নদীরক্ষা আন্দোলন, চলনবিল রক্ষা আন্দোলন, আত্রাই-গুমানি- নন্দকুঁজা ও বড়াল রক্ষা আন্দোলন ,নারদ নদ রক্ষা আন্দোলন কমিটি,  জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনসহ বিভিন্ন সরকারি- বেসরকারি সংস্থা নানাভাবে আন্দোলন করে সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টি করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সরকার বিভিন্ন সময়ে আদালতের নির্দেশে কিছু কার্যকরি পদক্ষেপ নিলেও প্রভাবশালী ভূমিখেকোদের কাছে নদী দখল উচ্ছেদ আর দুষণ রোধে সরকারের কর্মকর্তারা অসহায় হয়ে পড়েন। নদী কমিশনের চেয়ারম্যান নদী দখলে এক মহিলা মন্ত্রীকে  ইঙ্গিত করে কথা বলায় চেয়ারম্যানকে পদই হারাতে হলো।

নদীর সঠিক মালিকানা নিয়েও চলছিল টানাহ্যাঁচড়া। নদীর মালিকানা নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) হয়ে উঠেছিল  দূর্নীতির রাঘব বোয়াল। কথিত আছে পানিউন্নয়ন বোর্ডের অপরিকল্পিত প্রকল্পের কারণেই নদ-নদীর অপমৃত্যু হচ্ছে। নাটোর (গুরুদাসপুর-বড়াইগ্রাম) ৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য, চলনবিলের কৃতিসন্তা্‌  বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম  অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস বড়াল রক্ষা আন্দোলন কমিটি এবং বিভাগীয় সরকারী কর্মকর্তাদের সভায় অত্যন্ত ক্ষোভের সাথে বলেছিলেন “ আমি যদি এক ঘন্টার জন্যেও প্রধানমন্ত্রী হতাম তাহলে সর্বপ্রথম পানি উন্নয়ন বোর্ড বিলুপ্তির ঘোষণা  দিতাম।” উক্তিটি যথার্থই ছিল বলে নদী বিশেষজ্ঞদের অভিমত।

মহমান্য হাইকোর্ট নদ-নদীর দখল, দুষণ,ভরাট,সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে একটি ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করেন। একই সাথে মহামান্য আদালত নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয়- জলাধারের অবৈধ দখল ও দুষণকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করার আদেশ জারী করেছেন। রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ এর ৮৬ ও ৮৭ ধারা এবং ১৪৯(৪)ধারা অনুসারে জাতীয় নদী কমিশনকে নদীর জীবনী স্বত্বা রক্ষার মালিকানা প্রদান করে ঐতিহাসিক রায় প্রদান করেন। বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাও নদী খেকোদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন।

চলনবিল অঞ্চলের খ্যাতনামা সাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশি লিখেছেন, চারশত বছর পুর্বে এই বিলটি রাজশাহী,পাবনা, বগুড়ার অধিকাংশ স্থান জুড়ে বিরাজ করতো। ব্রহ্মপুত্র  ও পদ্মার সঙ্গমস্থলের পশ্চিম উত্তরাংশে চলনবিল বিরাজিত। অবস্থান, আকৃতি ও প্রকৃতিতে দেখা যায়,চলনবিলকে উত্তর বাংলার নদ-নদী স্নায়ু জলের নাভি কেন্দ্র। কিন্তু ১৯১৬ সালে পাকশি- সিরাজগঞ্জ এবং পাকশি-শান্তাহার রেল লাইন করায় বড়াল , আত্রাই- নন্দকুঁজা-গুমানিসহ সংশ্লিষ্ট আরও নদ- নদীর প্রস্থ সংকুচিত হয়ে পড়ে। এখান থেকেই শুরু হয় চলনবিলের নদ- নদীর অপমৃত্যুর উদ্বোধন ।

চলনবিলের প্রাণ সঞ্চালনকারী( জীবনদায়িনী) অন্যতম প্রধান নদী -আত্রাই-বড়াল-গুমানি এবং নন্দকুঁজা নদীর প্রবাহ পরিচিতি এ প্রজন্মের জানা দরকার। তা হচ্ছে-আত্রাই নদী নাব্যতা হারিয়ে এখন জোলায় পরিণত হয়েছে।  আত্রাই তিস্তার শাখা নদী। দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার উত্তরে এ নদী করতোয়া নদী নামে প্রবাহিত হচ্ছে। এ নদী ছোট যমুনায় মিশে দক্ষিণ-পুর্বে প্রবাহিত হয়ে নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার চাঁচকৈড় ত্রি-মোহনায় নন্দকুঁজার সাথে মিলিত হয়ে গুমানি নাম ধারণ করে পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার নুননগর এসে বড়ালের সাথে মিশে বড়াল নামে ভাঙ্গুড়া ও বনওয়ারীনগর ফরিদপুর উপজেলা হয়ে বেড়া উপজেলার কাছে মুল যমুনায় মিশেছে। এইজন্য আত্রাই নদীকে বলা হয় যমুনার উপনদী। আত্রাই নদী ছোট যমুনা থেকে প্রবাহিত হয়ে, নওগাঁ  হয়ে বৃহত্তর চলনবিলের বুকচিড়ে নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলা হয়ে গুরুদাসপুর উপজেলার  ত্রি-মোহনায় নন্দকুঁজা এবং গুমানি নদীর সাথে মিশেছে। আত্রাই নদীর নামকরনে নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলা নামে একটি উপজেলা এবং রেল ষ্টেশন স্থাপিত হয়েছে। আত্রাই নদীর পাড়ে ভাটরা পতিসরে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জমিদার বাড়ি অবস্থিত। এখানে বসেই কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ আমাদের ছোট নদী চলে  বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে’ কবিতাটি। আত্রাই নদীকে এক কথায় বলা হয় চলনবিলের মূল শিরা । কারণ আত্রাই নদীর দীর্ঘ প্রবাহের মাধ্যমেই চলনবিলের উৎপত্তি হয়ে বিস্তীর্ন এলাকাজুড়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যা এশিয়া মহাদেশের মধ্যে বৃহত্তর বিল বলে ইতিহাস খ্যাত।আত্রাই নদীর মুল প্রবাহেই চলনবিলের স্রোত  চলমান আছে আজো । সেই আত্রাই নদীর দুই পাড়ে পলি জমে নাব্যতা হারিয়ে এখন জোলায় পরিণত হয়েছে।

আত্রাই নদীর বহু উপনদী বা শাখা নদী রয়েছে। নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার ডান তীরে ফকিরনি নদী, নাটোরের সিংড়া উপজেলার বাম তীরে গুরনাই নদী এবং গুরুদাসপুর উপজেলার বাম তীরে হরদমা গ্রামে বেশানী নদী বর্তমানে ভাসানী নদী এবং যোগেন্দ্র নগর বাম তীরে মরা আত্রাই নামে শাখা প্রবাহিত। আত্রাই নদীর প্রত্যেক শাখা- উপ-শাখা দিয়ে পানির স্রোত গিয়ে পড়ছে চলনবিলের মধ্যে। এই শাখ-উপ-শাখার স্রোতধারার কারণেই চলনবিল চলমান। তাই নাম হয়েছে চলনবিল। আত্রাই নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ২৫০ কিলোমিটার।

আত্রাই নদীর নব্যতা উদ্ধারে ড্রেজিং কাজে দুর্নিতী ও অনিয়মের অভিযোগঃ  পাবনা জেলার বেড়া উপজেলার যমুনা থেকে বড়াল,গুমানী এবং আত্রাই নদীর নাব্যতা উদ্ধারের জন্য অভ্যন্তরীণ  নৌপরিবহন মন্ত্রনালয়ের (বিআইডব্লিউ টিএ) উদ্যোগে ২০১৭ সালে ড্রেজিং এর কাজ শুরু হয়  । নৌপরিবহন মন্ত্রনালয়ের তথ্যমতে বেড়া থেকে শুটকিগাছা রাবারড্যাম পর্যন্ত ১৩৫ কিলোমিটার খনন সম্পন্ন হয়েছে। ড্রেজিং এর কাজে গুরুদাসপুরের নদীরক্ষা আন্দোলন কমিটি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), সাংবাদিক  এবং সচেতন নাগরিক সমাজ ব্যাপক দূর্নীতি  , অনিয়মের অভিযোগ জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিষয়টি দুদক,জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন এবং বিআইডব্লিউটি এর কর্তৃপক্ষ অভিযোগ আমলে নিয়ে ১১/৪/২০১৯ তারিখে গুরুদাসপুর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে তাঁদের ম্যপিং জরিপের ভুল স্বীকার করেন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের  আশ্বাস  দেন।

বড়াল নদী ভুমি খেকোদের দখলেঃ  চলনবিলের জীবন সঞ্চালনের অন্যতম প্রধান ধমণী  হচ্ছে বড়াল নদী। রাজশাহী জেলার চারঘাট উপজেলার চারঘাট পদ্মা (গঙ্গা) থেকে বড়াল নদীর উৎপত্তি। চারঘাট পদ্মা থেকে বড়াল নদী প্রবাহিত হয়ে পুর্ব দিকে রাজশাহী জেলার বাঘা থানা এবং নাটোর জেলার লালপুর, বাগাতিপাড়ার দয়ারামপুর ক্যান্টনমেন্টের গা ঘেষে উত্তর-পুর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে বড়াইগ্রাম উপজেলার আটঘড়িয়া এসে পুর্বদিকে বনপাড়া, জোয়ারী, মৌখাড়া, বড়াইগ্রাম,  লক্ষ্মীকোল , জোনাইল, চাটমোহর উপজেলার ওপর দিয়ে ধানকুনা, নুননগর-বিন্যাবাড়ি গিয়ে গুমানী নদীর সাথে মিশে বড়াল নামেই ভাঙ্গুড়া উপজেলা, বনওয়ারীনগর ফরিদপুর উপজেলার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়ে বেড়া উপজেলায় যমুনার সাথে মিশেছে।

আশির দশক পর্যন্ত  পদ্মার  উর্বরা পলিযুক্ত পানির স্রোতের  তীব্রতায় ছিল প্রমত্তা । সেসময় এই স্রোতস্বিনী নদী দিয়ে চলত বাণিজ্যিক  বড় বড় নৌকা, বজরা, লঞ্চ, স্টীমারসহ নানা কাঠামোর জলযান। পাওয়া যেত সুস্বাদু নানা প্রজাতির মাছ। এই নদনীর তীরে গড়ে উঠেছে বনপাড়া, জোয়ারী, মৌখাড়া, লক্ষ্মীকোল , জোনাইল, হরিপুর এবং চাটমোহর হাটবাজার এবং বাণিজ্যিক কেন্দ্র।

প্রমত্তা  বড়াল নদী আজ মৃত । পদ্মার শাখা নদী রাজশাহী জেলার চারঘাট উপজেলা থেকে শুরু হয়ে পাবনার বেড়া পর্যন্ত চলনবিলের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়ে যমুনার সাথে সংযোগকারী বড়াল নদী। বড়াল নদীর দৈর্ঘ্য ২২০ কিলোমিটার। রাজশাহী, নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জসহ ৪ টি জেলার চারঘাট, বাগাতিপাড়া, লালপুর,বড়াইগ্রাম, চাটমোহর,ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর,শাহজাদপুর ও বেড়া উপজেলাসহ ৯ টি উপজেলার মধ্যে দিয়ে বড়াল প্রবাহিত। বড়ালে অনেক শাখা, উপ-শাখা প্রবাহ আছে।

আশির দশকের পর সেই  স্রোতস্বিনী বড়াল নদী পানি উন্নয়ন বোর্ডের সীমাহীন দূর্নীতি  আর স্বেচ্ছাচারীতার কারণে আজ সম্পুর্ণ মৃত। এর সাথে শাখা,উপ শাখাও মৃত এবং দখলদারদের দৌরাত্বে বিলুপ্ত। ১৯৮২ সালে পদ্মা থেকে বড়ালের উৎসমুখ রাজশাহী জেলার চারঘাটে বড়ালের প্রশস্ততা সংকুচিত করে ৩০০ ফুট থেকে হ্রাস করে ৩৫ ফুট প্রস্থ স্লুইস  গেট নির্মাণ করে এবং স্লুইচ    গেট থেকে উজানে পদ্মা পর্যন্ত সংকুচিত করে পানি প্রবাহের গতি কমানো হয়। ১৯৮৯ সালে চারঘাট থেকে ৪৬ কিলোমিটার ভাটিতে বাগাতিপাড়া এবং বড়াইগ্রাম উপজেলার সীমান্ত দয়ারামপুরের -আটঘড়িয়া এসে পুর্বদিকে প্রবাহিত বড়ালের মুখে দুইপাড় আরো সংকুচিত করে এবং বড়ালের শাখা নদী নন্দকুজা নদীর মুখে আরো দুইটি ¯স্লুইস গেট ও ৩টি ক্রসবাঁধ নির্মাণ করায় প্রমত্তা  বড়াল ও নন্দকুঁজা জীবন প্রবাহের মৃত্যু ঘটে। । চারঘাট থেকে প্রবাহিত বড়ালের শাখা নদীগুলিই হচ্ছে নারদ নদ,নন্দকুঁজা, মির্জা মাহমুদ ,মুসা খাঁ ,বোয়ালিয়া এবং তুলসি  নদী। এই নদীগুলিই চলনবিলের প্রাণ।

বড়ালের প্রধান শাখা নদী নন্দকুঁজা বড়াইগ্রাম উপজেলার আটঘড়িয়া থেকে উৎপত্তি হয়ে উত্তর দিকে বড়াইগ্রাম উপজেলার আহমেদপুর,নাটোর সদর উপজেলার হালসা, সিংড়া উপজেলার বাহাদুরপুর, হেলাইগাড়ি এবং গুরুদাসপুর উপজেলার চন্দ্রপুর,নাজিরপুর ,গুরুদাসপুর পৌরসভার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চাঁচকৈড় ত্রি-মোহনায় এসে আত্রাই ও গুমানি নদীতে মিশেছে। আটঘড়িয়া থেকে চাঁচকৈড় ত্রি- মোহনা পর্যন্ত নন্দকুঁজা নদীর দৈর্ঘ্য ৬০ কিলোমিটার।

১৯৮৯ সালে আটঘড়িয়ায় বড়াল নদী থেকে উৎপত্তিস্থলে বড়াল- নন্দকুঁজা নদীর মুখে দুই পাড় সংকুচিত করে ¯স্লুইস গেট নির্মাণ  করায় পানির স্বাভাবিক প্রবাহ নিয়ন্ত্রন করায় মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। নন্দকুঁজা নদী বড়ালের শাখা নদী বিধায় পদ্মার পানির প্রবাহ নন্দকুঁজা নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চাঁচকৈড় ত্রি- মোহনায় গুমানি নদীতে পড়ে। আটঘড়িয়ায় অ-প্রশস্ত  স্লুইস গেটের কারণে বড়ালের মুল স্রোত  নন্দকুঁজা দিয়ে প্রবাহিত হয়। কিন্ত নন্দকুঁজার মুখেও  স্লুইসগেট নির্মাণ করায় পানির স্বাভাবিক প্রবাহ কমে বর্ষা মওসুমে অর্ধেকেরও নীচে প্রবাহিত হচ্ছে। আটঘড়িয়া থেকে চাঁচকৈড় পর্যন্ত আহমেদপুর , হালসা, চন্দ্রপুর, হোলাইগাড়ি, নাজিরপুর , গুরুদাসপুর ও চাঁচকৈড় হাটবাজার ও ব্যবসা বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। নাটোর সুগারমিল এবং যমুনা ডিষ্টিলারিজের বিষাক্ত বর্জ্য নারদ নদ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নন্দকুঁজা নদীতে পড়ে পানি দুষিত হচ্ছে। ফলে নারদসহ নন্দকুঁজা নদীর মাছ ও জলজ সম্পদ মরে- পচে নদী এলাকার পরিবেশ মারাত্বক ভাবে দুষিত করছে। এছাড়াও নন্দকুঁজা নদীতে বেশীরভাগ সময় পানি না থাকায় এবং পলি জমে দুই পাড় ভরাট হওয়ায় প্রভাবশালী ভুমি খেকোরা দখল করে প্রমত্তা  নদীকে নির্মমভাবে হত্যায় মেতে উঠেছে। বড়ালসহ এই নন্দকুঁজা নদীকে সকল প্রকার দখল-দুষণ থেকে রক্ষা এবং চারঘাট ও আটঘড়িয়ার স্লুইস গেট অপসারণের  দাবীতে গুরুদাসপুরের নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটি মানব বন্ধন, নদীপথে ৪০ কিলোমিটার নৌ র‌্যালীসহ বহু কর্মসুচি পালন করে আসছে।

মির্জামাহমুদ নদী বড়াইগ্রাম উপজেলার কাছুটিয়া বড়াল নদী থেকে উৎপত্তি। কাছুটিয়ার বড়াল নদী থেকে মির্জামাহমুদ নদীর প্রবাহ গুরুদাসপুর উপজেলার কান্দাইল, ধানুড়া, পুরুলিয়া, তুলাধুনা চন্দ্রপুর, চকআলাদত খাঁ, গোপিনাথপুর হয়ে চাকলের বিলের ভিতর দিয়ে সোনাবাজু ঝাঁকড়া হয়ে পুর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে বড়াল নদীর আর এক শাখা তুলসিগঙ্গা নদীতে মিশেছে।

কথিত আছে একসময়ে এই মির্জমাহমুদ নদী দিয়ে বড় বড় বা্জ্যিণিক নৌকা ,বজরা , লঞ্চ চলাচল করত। বর্তমানে এই স্রোতস্বিনী নদী সম্পুর্ণ মৃত। নদীখেকোরা নদীর উৎসমুখ থেকে ধানুড়া পর্যন্ত দখল করে নিয়েছে। পুরুলিয়া থেকে গোপিনাথপুর হয়ে চাকলের বিলে ভিতর দিয়ে সোনাবাজু পর্যন্ত এখনও নদীর ধারা থাকলেও দখলদাররা চন্দ্রপুর এলাকায় নদীর মধ্যে পুকুর খনন করে মাছ চাষ করছে। বর্ষা মৌসুমে এই নদী দিয়ে ধানুড়া , হালসা, রানিনগর , চন্দ্রপুর , গোপিনাথপুর, বৃকাশো ও চাকলের বিলের পানি নিস্কাশিত হয়। মির্জামামুদ নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫ কিলোমিটার।

তুলসিগঙ্গা এবং বোয়ালিয়া নদী মানচিত্র থেকেই বিলুপ্ত। বড়াইগ্রাম উপজেলায় জোয়ারি  থেকে বড়াল নদী শুরু । জোয়ারি থেকে   থেকে বড়াল  উত্তর-পুর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে নওদাজোয়ারি, গুরুদাসপুর উপজেলার চাপিলা, খামারপাথুরিয়া, নওপাড়া, ইদিলপুর, তেলটুপি, মকিমপুর ,রওশনপুর , ঝাঁকড়া, সোনাবাজু, পোয়ালশুরা পাটপাড়া, শিধুলি, ধারাবারিষা হয়ে  বড়াইগ্রাম  উপজেলার ভিটাকাজিপুর হয়ে দক্ষিণ  চলনবিলের চেঁচুয়ার বিলের মধ্যদিয়ে পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার বোয়াইলমারী -ধানকুনিয়া  হয়ে  কিনুর ধর গিয়ে গুমানি নদীতে মিশেছে। তুলসি নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। দখলদারদের দৌরাত্বে একসময়ের প্রমত্তা  তুলসি নদী জোয়ারি উৎসমুখ থেকে রওশনপুর পর্যন্ত পুকুর খনন করে মাছ চাষ , বসতবাড়ি,মসজিদসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ  করেছে। এমনকি এই নদী প্রভাবশালীদের মদদে মানচিত্র থেকেই হারিয়ে গেছে।

গুরুদাসপুর উপজেলার নাজিরপুরের মামুদপুর দিয়ে  প্রবাহিত  নন্দকুঁজা  নদীর শাখা বোয়ালিয়া নদী।  বোয়ালিয়া নদীর প্রবাহ উৎপত্তিস্থল নন্দকুঁজা থেকে মামুদপুর , জুমাই নগর, বিন্যাবাড়ি, দক্ষিণ  নাড়ীবাড়ি, শিধুলি, উদবাড়িয়া, দাদুয়া, খাঁকড়াদহ, এবং বড়াইগ্রাম উপজেলার কচুগাড়ি হয়ে ভিটাকাজিপুর তুলসিগঙ্গা নদীর সাথে মিশেছে। দখলদারদের দৌরাত্বে নদীটির অস্তিত্ব মানচিত্র থেকেই হারিয়ে গেছে।  উপজেলার নদীর তালিকায় বোয়ালিয়া নদীর কোন নামগন্ধই নাই। এই নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫ কিলোমিটার। তুলসিগঙ্গা ,মির্জামাহমুদ এবং বোয়ালিয়া নদীর পানি দক্ষিণ  চলনবিলের প্রাণ সন্চালন করত এবং বিশাল অঞ্চলের সব কয়টি বিলের পানি নিস্কাশিত হয়।

সুপারিশঃ  নদী-জলা-জলাশয় রক্ষায় আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক সি এস রেকর্ড অনুযায়ী জরিপ করে সীমানা নির্ধারণ পুর্বক অবৈধ দখল উচ্ছেদ ও পুনঃখনন করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে। বড়াল ও নন্দকুঁজা নদীর তিনটি স্লুইস গেটসহ সকল অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হবে। পৌরসভা, হাট-বাজার এবং কল- কারখানার সকল প্রকার বর্জ্য নদীতে ফেলা বন্ধ করতে হবে। নদীর উপর স্থাপিত চারঘাট এবং আটঘড়িয়ার  স্লুইস গেটসহ সকল প্রকার অবৈধ স্থাপনা অপসারণ করতে হবে।নৌ পুলিশ গঠন করতে হবে। আর প্রতিবাদ নয়, প্রতিরোধ আর  গণজোয়ার গড়ে তুলতে হবে।

 

 

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..

সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত