‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ বলা হয় তাকে। ছিলেন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। পরে পাকিস্তান সৃষ্টি হলে পাকিস্তানের পঞ্চম প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন। গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করে গেছেন এই মহান নেতা। পাকিস্তানি আমলে পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের বিভিন্ন অনাচার ও অনিয়মের বিরুদ্ধে সরব ও সক্রিয় ছিলেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনে যাদের প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল, তাদের মধ্যে একজন—তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। বাংলাদেশের নামকরণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কিংবদন্তী রাজনীতিবিদ সোহরাওয়ার্দীর নাম। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের নামকরণ করেছিলেন। উপমহাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী ও সুপরিচিত, কিংবদন্তি এই রাজনীতিবিদের মৃত্যুবার্ষিকী আজ ৫ ডিসেম্বর।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ৫ ডিসেম্বর এলেই তার কর্মময় জীবন নিয়ে যেমন আলোচনা হয় তেমনি বিদগ্ধজনের অনেকেই আলোচনায় তোলেন লেবাননের হোটেলে তার মৃত্যুর রহস্য নিয়েও। ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর লেবাননের বৈরুতের একটি হোটেলে নিঃসঙ্গ অবস্থায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মৃত্যুবরণ করেন। এই মৃত্যু নিয়ে ওইসময়ে রাজনৈতিক ময়দান নানাভাবে উত্তপ্ত হয়েছিল।
সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল তরুণ বয়সেই, উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে। তৃতীয় দশকে এসে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন রাজনীতিতে। সোহরাওয়ার্দী তার গৌরবোজ্জ্বল রাজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন সময় নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ১৯২৪ সালে কলকাতা করপোরেশনের ডেপুটি মেয়র, ১৯৩৭ সালের নির্বাচনোত্তর ফজলুল হক কোয়ালিশন মন্ত্রিসভার শ্রম ও বাণিজ্যমন্ত্রী, ১৯৪৩-৪৫ সালে খাজা নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রিসভায় বেসামরিক সরবরাহ মন্ত্রী, ১৯৪৬-৪৭ সালে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী, পাকিস্তান আমলে ১৯৫৪-৫৫ সালে মোহাম্মদ আলীর মন্ত্রিসভার আইনমন্ত্রী। ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত ১৩ মাস পাকিস্তানের পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম লীগকে বাংলায় সুপ্রতিষ্ঠিত করা এবং এর অগ্রযাত্রায় সোহরাওয়ার্দীর ভূমিকা ছিল অসামান্য। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম ও প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগ (পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ) প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। পরে গণতন্ত্রকামী বিভিন্ন দলের সমন্বয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন এবং ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রথম প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক বিজয়ের পেছনেও ক্রিয়াশীল ছিল তার দারুণ নেতৃত্ব।
সমাজ, রাষ্ট্র, গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার তাকে ভাবিয়েছে আমৃত্যু। প্রসঙ্গত প্রাবন্ধিক সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখেছেন, “একালে অনেকের কাছেই বিস্ময়কর মনে হবে, বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠায় পূর্ব বাংলার কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা নেই, জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদদের দ্বারাই এটি প্রতিষ্ঠিত। বিশেষ করে তখনকার প্রধান বিরোধীদল বাঙালি জাতীয়তাবাদী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অবদান সবচেয়ে বেশি। তার সঙ্গে ছিলেন বাম-প্রগতিশীল সংগঠনগুলোর নেতারা। যেমন- ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে একে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী ও হোসেইন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট যে (আবুল মনসুর আহমদ প্রণিত) ২১ দফা অঙ্গীকার করে তার ১৬ নম্বর দফায় বলা হয়েছিল, ‘যুক্তফ্রন্টের প্রধানমন্ত্রী বর্ধমান হাউসের পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত কম বিলাসের বাড়িতে বাসস্থান নির্দিষ্ট করিবেন এবং বর্ধমান হাউসকে আপাতত ছাত্রাবাস এবং পরে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে পরিণত করা হইবে।’” (বাঙালি মুসলমানের বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রম ও বিশ্বাসহীনতা: সৈয়দ আবুল মকসুদ)
এক নজরে তার জীবন বিশ্লেষণ করলে জানা যায়, ১৯২২-এ স্বরাজ পার্টিতে যোগ দিয়ে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এটি তখন মূলত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দলের ভেতরের একটি গ্রুপ ছিল। ১৯২৩ এর বেঙ্গল প্যাক্ট স্বাক্ষরে ভালো ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। ১৯২৪ সালে তিনি কলকাতা পৌরসভার ডেপুটি মেয়র নির্বাচিত হন। তবে ১৯২৭ এ সেই পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯২৮ সালে সর্বভারতীয় খিলাফত সম্মেলন এবং সর্বভারতীয় মুসলিম সম্মেলন অনুষ্ঠানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মুসলমানদের মধ্যে তার ব্যাপক রাজনৈতিক প্রভাব থাকলেও ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত মুসলিম লীগের সাথে তিনি জড়িত হননি। ১৯৩৬ সালের শুরুর দিকে তিনি ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট মুসলিম পার্টি’ নামক দল গঠন করেন। ১৯৩৬-এর শেষের দিকে এই দলটি বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাথে একীভূত হয়। এই সুবাদে তিনি বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল মুসলিম লীগ তথা বিপিএমএল-এর সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। ১৯৪৩ সালের শেষ দিক পর্যন্ত এই পদে ছিলেন। ১৯৪৩ সালে শ্যমা-হক মন্ত্রিসভার পদত্যাগের পরে গঠিত খাজা নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রিসভায় তিনি একজন প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন। খাজা নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রিসভায় তিনি শ্রমমন্ত্রী, পৌর সরবরাহ মন্ত্রী ইত্যাদি দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৬-এর নির্বাচনে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের বিপুল বিজয়ে মূল কৃতিত্বের দাবিদার তিনি এবং আবুল হাশিম। ১৯৪৬ সালে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তান আন্দোলনে তিনি ব্যাপক সমর্থন প্রদান করেন। পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ১৯৪৬ সালে তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের প্রতি তার সমর্থন এবং সহযোগিতা প্রদান করেন।
১৯৪৬ সালে নির্বাচনের পর পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের বিষয় প্রায় চূড়ান্ত রূপ পায়। এসময় জিন্নাহ সোহরাওয়ার্দীকে দিয়ে অখণ্ড পাকিস্তানের প্রস্তাব করান। কিন্তু বাংলার মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে সোহরাওয়ার্দী উপলব্ধি করেন- বাংলার হিন্দু মুসলমানের সমস্যা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতো না, কিছুটা স্বতন্ত্র। নিজের অভিজ্ঞতা, মহৎ পরিকল্পনার সহযোগী দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র শরৎচন্দ্র বসু ও আবুল হাশিমের অনুপ্রেরণায় সিদ্ধান্ত নেন ভারতের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে আলাদা সার্বভৌম বাংলা গঠনের। এই বিষয়ে ১৯৪৭ সালের ১৩ মে এক বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘বাংলা ও ভারতের সমস্যার মধ্যে এক বিরাট ব্যবধান, কারণ বাঙালি একটি জাতি, একই ভাষাভাষী, বহু দিক, বহু বিষয়ে তাহাদের মধ্যে মিল রহিয়াছে, তাহারা পরস্পর পরস্পরকে অনুধাবন করিতে সমর্থ।’ (আমার জীবনস্মৃতি: মাহমুদ নুরুল হুদা)
স্বাধীন ভারতবর্ষের ব্যাপারে কেবিনেট মিশন প্ল্যানের বিরুদ্ধে জিন্নাহ ১৯৪৬ সালের আগস্ট ১৬ তারিখে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের ডাক দেন। বাংলায় সোহরাওয়ার্দীর প্ররোচনায় এই দিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। মুসলমানদের জন্য আলাদা বাসভূমি পাকিস্তানের এমন দাবিতে এই দিন মুসলমানরা বিক্ষোভ করলে কলকাতায় ব্যাপক হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বেঁধে যায়। পূর্ব বাংলার নোয়াখালীতে এইদিন চলে বিপুল ধ্বংসযজ্ঞ। সোহরাওয়ার্দী এসময় তার নীরব ভূমিকার জন্য হিন্দুদের নিকট ব্যাপক সমালোচিত হন। এরপর তার উদ্যোগে ১৯৪৬ সালে দিল্লি সম্মেলনে মুসলিম লীগের আইন প্রণেতাদের নিকট লাহোর প্রস্তাবের একটি বিতর্কিত সংশোধনী পেশ করা হয়। এই সংশোধনীতে অখণ্ড স্বাধীন বাংলার প্রস্তাবনা ছিল। কিন্তু কলকাতায় হিন্দু মুসলমান দাঙ্গায় তার বিতর্কিত ভূমিকার কারণে হিন্দুদের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়। ফলে শরৎচন্দ্র বসু ছাড়া কংগ্রেসের আর কোনো নেতা তার অখণ্ড বাংলার ধারণার সাথে একমত ছিলেন না।
৪৬ সালের দাঙ্গার শুরুর পরের দিন কলকাতায় খেলাফত কমিটি ও মুসলিম লীগের নেতারা জান মোহাম্মদের নেতৃত্বে সোহরাওয়ার্দীর বাসায় বৈঠকে বসেন। তারা তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘আপনার বেয়ারা শিবুকে এই মুহূর্তে সরিয়ে দিন এবং হিন্দু নাপিত জগদীশকে শেভ করাতে বাসায় আসতে বারণ করুন। সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক সচিব মাহমুদ নুরুল হুদা বলেন, সোহরাওয়ার্দী প্রস্তাবে রাজি না হয়ে বলেন এটা করলে নিজেকে সাম্প্রদায়িক হিসেবে পরিচয় করাবো। আর তা করে কোন যুক্তিতে হিন্দু মুসলমানের মিলনের জন্য প্রচারকার্য চালাবো? তার এই অবস্থানে সবাই অবাক হন। এ ঘটনায় তার চিন্তা ও জীবন দর্শন সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়।’
রক্ষণশীল হিন্দু নেতৃত্বের একটি অংশ তাকে ডাইরেক্ট অ্যাকশন দিবসের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে অভিযুক্ত করার অপচেষ্টা চালায়। তবে মহাত্মা গান্ধী এই অভিযোগ গ্রহণ করেননি, কারণ তিনি সত্যটা জানতেন। শুধু অবিভক্ত বঙ্গের মূখ্যমন্ত্রীই নয়, কলকাতার মুসলমানদের কাছে তিনি ছিলেন মুকুটহীন সম্রাট। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজে গাড়ি চালিয়ে কলকাতার অলিতে-গলিতে দাঙ্গাবিরোধী মিশন নিয়ে তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন। এই সাহসিকতায় বিমুগ্ধ হয়ে গান্ধী দাঙ্গাকবলিত নোয়াখালীতে তাকে সফরসঙ্গী করেন। ১৯৪৭ সালে তিনি বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যান। তবে পদত্যাগের পর তিনি সাথে সাথে পাকিস্তান না গিয়ে কলকাতায় থেকে যান। সোহরাওয়ার্দী ৪৭ এর দেশভাগের সাথে সাথে পাকিস্তানে চলে যাননি।
প্রসঙ্গত সোহরাওয়ার্দীর এই না যাওয়া মুসলমানদের মধ্যে সমালোচিত হয়। এই প্রসঙ্গে আবুল মনসুর আহমদ তার আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর বইয়ে উল্লেখ্য করেন: “৪৭’ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর কেন্দ্রের মন্ত্রিত্ব নিলেন না। কায়েদে আযম ও প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত খাঁর অনুরোধের জবাবে তিনি (সোহরাওয়ার্দী) জানাইলেন; ভারতীয় মুসলমানদের একটা হিল্লা না করিয়া তিনি ভারত ছাড়িতে পারেন না। তিনি এ ব্যাপারে কায়েদে আযমের কাছে যেসব তার ও চিঠি দিয়াছিলেন, আমি তা দেখিয়াছিলাম। তাতে তিনি বলিয়াছিলেন: ‘আপনার সুদক্ষ পরিচালনায় পাকিস্তানের হেফাজত করিবার যোগ্য লোকের অভাব নাই। কারণ মুসলিম লীগের প্রায় সব নেতাই পাকিস্তানে চলিয়া গিয়াছেন। কিন্ত পিছনে ফেলিয়া যাওয়া বেচারা ভারতীয় মুসলমানদের হেফাজত করিবার কেউ নাই। আমাকে এদের সেবা করিতে দিন।’ কথাটা খুবই মহৎ ও অতুলনীয়। কিন্তু ভারতেও থাকতে পারেননি তিনি। ১৯৪৯ সালে তৎকালীন ভারত সরকার তার ওপর ক্রমবর্ধমান করের বোঝা চাপালে তিনি ভারত ত্যাগ করে পাকিস্তান চলে যেতে বাধ্য হন। ভারতে অবস্থান করার জন্য তাকে গুণতে হচ্ছিল বাড়তি আয়কর। শেষ পর্যন্ত সোহরাওয়ার্দী করাচিতে তার শ্বশুর স্যার আবদুর রহিমের বাসভবনে উঠেন।”
তবে সোহরাওয়ার্দীর পাকিস্তানে না যাওয়ার বিষয়টি একপাক্ষিক সিদ্ধান্ত ছিল না। বিপদের দিনে মুসলমানদের জীবন রক্ষা ও পাকিস্তান আন্দোলনে যার ছিল ঐতিহাসিক অবদান, সেই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রতি পাকিস্তান সৃষ্টির পর নেতৃবৃন্দের আচরণ ছিল খুবই দুর্ভাগ্যজনক। যে নাজিম উদ্দিনকে তিনি নিজের দুটি সিটের একটিতে বিজয়ী করে এনেছিলেন, তার নেতৃত্বাধীন সরকারই ১৯৪৭ পরবর্তীকালে সোহরাওয়ার্দীর পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। অপরদিকে সোহরাওয়ার্দীর সাংগঠনিক দক্ষতার প্রতি জিন্নাহর যে আস্থা ছিলো তার ভয়ে কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান সোহরাওয়ার্দীকে ‘ভারতের লেলিয়ে দেয়া কুকুর’ বলে গালি দিতেও দ্বিধা করেননি।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যেমন ছিল সোহরাওয়ার্দীর ঐতিহাসিক অবদান, তেমনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এ রাষ্ট্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিনি মুসলিম লীগ সরকারের একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করেন। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের গণবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে তিনি এদেশের জনগণকে সোচ্চার ও সংগঠিত করেছিলেন। ১৯৪৭-এর আগস্টে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পরে খাজা নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে শক্তিশালী হয়ে ওঠেন মুসলিম লীগের রক্ষণশীল নেতারা। এর আগে ১৯৪৭ সালের আগস্ট ৫-এ খাজা নাজিমুদ্দিন জিন্নাহর পরোক্ষ সমর্থনে মুসলিম লীগের সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত হন। এরপর থেকে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক মুসলিম লীগের প্রগতিশীল নেতারা কোনঠাসা হয়ে পড়েন। খাজা নাজিমুদ্দিন পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী হবার পর বেশ কয়েকবার সোহরাওয়ার্দীকে ‘ভারতীয় এজেন্ট’ এবং ‘পাকিস্তানের শত্রু’ হিসেবে অভিহিত করেন। সোহরাওয়ার্দীকে পাকিস্তানের আইনসভার সদস্য পদ থেকে অপসারিত করা হয়।
সে সময়ে সোহরাওয়ার্দীর অনুসারীরা অনেকে ১৯৪৮-এর শুরুর দিকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ এবং ১৯৪৯-এর জুনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেমের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগঠনটির নাম থেকে ১৯৫৫ সালে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠালগ্নে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হন আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সহ-সভাপতি হন আতাউর রহমান খান, শাখাওয়াত হোসেন ও আলী আহমদ। টাঙ্গাইলের শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও একে রফিকুল হোসেনকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কোষাধ্যক্ষ হন ইয়ার মোহাম্মদ খান। কারাগারে অন্তরীণ থাকা অবস্থাতেই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান মুজিব। অন্যদিকে, পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনটির নাম রাখা হয় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ।
কেবল একজন রাজনৈতিক নেতাই নন, সোহরাওয়ার্দী ছিলেন একজন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়কও। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা প্রশ্নে তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। তখন তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি। গবেষক মিজানুর রহমান খান বায়ান্নর গোপন মার্কিন দলিল বইতে লেখেন, “ভাষা প্রশ্নে সোহরাওয়ার্দী নানা সময়ে বিভিন্ন ধরনের ভূমিকা পালন করেন বলে প্রতীয়মান হয়। ১৯৫১ সালের ৬ জানুয়ারি ঢাকার মার্কিন কনসাল চার্লস ডি উইদার্স তার পূর্ব পাকিস্তান সফর সম্পর্কে একটি বার্তা পাঠান। সোহরাওয়ার্দী এ সময় জনসভাগুলোতে বাংলা ও উর্দু মিশিয়ে বক্তৃতা করেন। উইদার্স লিখেছেন, ‘আমরা অবহিত হয়েছি যে সোহরাওয়ার্দী কার্যত জনতাকে তার হাতের তালুতে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি কখনো উর্দু, কখনো বাংলায় কথা বলেন। তিনি সমবেত জনতার সকল অংশকে সন্তুষ্ট করতে সফল হয়েছিলেন। সন্দেহাতীতভাবে সোহরাওয়ার্দী একজন চালাক মানুষ। দুটি বিষয়ে তার ব্যাখ্যা তার উদ্ভাবনপটুতার উদাহরণ তৈরি করে।’”
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর বাঙালির মধ্যে যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটেছিলো, তার নেতৃত্বও দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৫৩ সালে তিনি একে ফজলুল হক এবং মাওলানা ভাসানীর সাথে একত্রে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিতব্য পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচন উপলক্ষে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে পরাভূত করার জন্য আওয়ামী মুসলিম লীগের উদ্যোগে এই যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্তান খেলাফত পার্টির সঙ্গে মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। এই যুক্তফ্রন্টের নেতা ছিলেন মাওলানা ভাসানী, একে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এই যুক্তফ্রন্ট ২১ দফার একটি নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে। ওই ইশতেহারের মধ্যে প্রধান দাবি ছিল— লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা, ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ও সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা, ভাষা শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে শহীদ মিনার নির্মাণ করা ইত্যাদি। ১৯৫৪ সালের মার্চের আট থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট পায় ২২৩টি আসন। এরমধ্যে ১৪৩টি পেয়েছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ। সম্পূর্ণরূপে পরাভূত হয় ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ। তারা শুধু নয়টি আসন লাভ করে। সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার ফল ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে অবিস্মরণীয় বিজয়। গণতান্ত্রিক রীতি ও জনমতের প্রতি সর্বদা শ্রদ্ধাশীল থাকায় সুধী সমাজের কাছে ওইসময়ে তিনি ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ হিসাবে আখ্যায়িত হন। এরপর মোহাম্মদ আলী বগুড়ার মন্ত্রিসভায় সোহরাওয়ার্দী আইনমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তিনি ডিসেম্বর ১৯৫৪ থেকে আগস্ট ১৯৫৫ পর্যন্ত এ পদে ছিলেন।
সোহরাওয়ার্দীর কর্মশক্তি সম্পর্কে রাজনীতিবিদ আতাউর রহমান খান লিখেছিলেন, সোহরাওয়ার্দীর কর্মক্ষমতা দেশে প্রবাদে পরিণত হয়েছে। কী রাজনীতি ক্ষেত্রে, কী ওকালতি ব্যবসায় তিনি দিনরাত খাটতে পারতেন। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে যুক্তফ্রন্টের কাজ তিনি যেভাবে সম্পন্ন করেছেন, তা জীবনে ভুলবার নয়। শিশুর মতো মানুষটি ঘড়ির কাঁটা ধরে ঘুমাতে পারতেন। পারতেন উঠতেও। একবার রাজনৈতিক মিটিং শেষে ফেনী থেকে চাটগাঁ রওনা হই। স্টেশনে পৌঁছতে তখনও কুড়ি মিনিটের মতো বাকি। বললেন, বারো মিনিট ঘুমিয়ে নেই, তার আট মিনিট পর রেডি হয়ে যাবেন। তিনি করলেনও তাই। সময়কে তিনি গোলাম বানিয়েছেন। (দৈনিক ইত্তেফাক: ৫ ডিসেম্বর, ১৯৮৮)
আগস্ট ১৯৫৫ থেকে সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ পর্যন্ত পাকিস্তান আইনসভায় বিরোধীদলীয় নেতার ভূমিকা পালন করেন তিনি। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণয়নে তার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। এছাড়া তিনি সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ থেকে অক্টোবর ১৯৫৭ পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৫৬ সালে চৌধুরি মোহাম্মদ আলির পদত্যাগের পর তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। পররাষ্ট্র বিষয়ে পাকিস্তানের যুক্তরাষ্ট্রপন্থী মনোভাবের ব্যাপারে তাকে অগ্রদূত হিসেবে অভিহিত করা হয়।
১৯৫৬ সালে সংখ্যা-সাম্যের ভিত্তিতে একটি শাসনতন্ত্র গৃহীত হয়। উর্দুর সঙ্গে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হয়। কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের ১৩ জন এমএনএ থাকা সত্ত্বেও রিপাবলিকান পার্টির সহযোগিতায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হন। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যেকার অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণে দারুণ কিছু উদ্যোগ নেন তিনি। কিন্তু তার এই পদক্ষেপ ব্যাপক রাজনৈতিক বিরোধিতার জন্ম দেয়। পূর্ব পাকিস্তানের মতো পশ্চিম পাকিস্তানেও এক ইউনিট ধারণা প্রচলনে তার চেষ্টা পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিবিদদের কারণে নস্যাৎ হয়ে যায়। এরপর ১৯৫৮ সালে ইস্কান্দার মীর্জা পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন। আগস্ট, ১৯৫৯ থেকে ইলেক্টিভ বডি ডিসকোয়ালিফিকেশান অর্ডার অনুসারে তাকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে রাষ্ট্রবিরোধী কাজের অপরাধ দেখিয়ে তাকে জানুয়ারি ৩০, ১৯৬২-তে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং করাচি সেন্ট্রাল জেলে অন্তরীণ করা হয়। ১৯৬২-এর ১৯ আগস্ট মুক্তি পান তিনি। অক্টোবর, ১৯৬২-তে তিনি আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের উদ্দেশ্যে দুই পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মিলে ন্যাশনাল ডেমোক্রাটিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) গঠন করেন।
নূরে আলম সিদ্দিকীর এক স্মৃতিকথায় জানা যায়; একবার কারাগারে মুজিব ভাইয়ের মুখে শুনেছি আইয়ুব খান তার স্যারকে (সোহরাওয়ার্দী) বলেছিলেন যে প্রেসিডেন্ট পদটি ছাড়া আপনি যে পদটি চাইবেন সেখানেই আপনাকে অধিষ্ঠিত করা হবে। স্মিতহাস্যে সোহরাওয়ার্দীর জবাব ছিল, আপনার স্বঘোষিত ৬২-এর শাসনতন্ত্র প্রত্যাহার করে ৫৬-এর শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচন প্রদান করুন; এ ছাড়া আমার আর কোনো চাওয়া নেই। আইয়ুব খানও সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করতেন অকুতোভয় ও নির্লোভ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী জনমত গঠন করে তাকে উৎখাত করতে পারেন। তাই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং এক আদেশে রাজনীতি তার জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টার অপরাধে পাকিস্তান আমলে জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের সময় বৃদ্ধ বয়সে তাকে দীর্ঘদিন কারাবরণ করতে হয়। দীর্ঘ কারাবাসে তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে।
১৯৬২ সালের ৩১ ডিসেম্বর তিনি প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন। সুচিকিৎসার জন্য তিনি ১৯৬৩ সালের ১৯ মার্চ বৈরুত যান। সেখানে আরোগ্য লাভ করে তিনি লন্ডনে তার পুত্র রাশেদ সোহরাওয়ার্দীর কাছে ছয় মাস ছিলেন। বৈরুতে চিকিৎসা করতে যাবেন তখন আতাউর রহমান খান, সালাম খান, জহিরউদ্দিন সাহেব, আবুল মনসুর আহমদ, খাজা খয়রাত হোসেনসহ সবাই নেতাকে প্রশ্ন করলেন, স্যার, আমাদের জন্য কী রেখে যাচ্ছেন? তিনি বললেন, একটি কলম আর একটি মাঠ। অর্থাৎ, মানিক (তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া) ও মুজিবকে (শেখ মুজিবুর রহমান) তোমাদের কাছে রেখে গেলাম। লন্ডনে সোহরাওয়ার্দী পুনরায় অসুস্থ হলে বৈরুত যান। তিনি ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর বৈরুতের কন্টিনেন্টাল হোটেলে মৃত্যুবরণ করেন। সেসময় অনেকে সন্দেহ করেন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান তাকে সুকৌশলে হত্যা করেছেন।
আমরা যখন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জীবন সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি কিংবা জীবনী পড়ি, তখন তার মৃত্যু সর্ম্পকে সবসময় একটি লাইনই কেবল পাই। আর তা হলো, ‘তার মৃত্যু অনেকের কাছে রহস্যমণ্ডিত’। কিন্তু এই রহস্য কি, তা আমরা জানি না। জানার সুযোগও কখনো পাইনি, জানার চেষ্টাও হয়তো কখনো করি নাই। এই চেষ্টা যেমন ব্যক্তিগতভাবে হয়নি তেমনি হয়নি রাষ্ট্রীয়ভাবেও। শুধু জানা যায়, পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বৈরুতেরই এক হোটেলে ঘুমের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়েছিলেন।
তবে এটাও সত্যি যে, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো একজন মানুষ এখনো আমাদের ইতিহাসে উপেক্ষিত থেকে গেছেন। তাকে নিয়ে ইতিহাসও বিকৃত হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে তাকে নিয়ে বলা হয়েছে, ‘শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের তুলনায় সোহরাওয়ার্দীর দেশপ্রেম অনেক কম ছিল, তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েও বাংলার জন্য কিছু করেননি’। শুধু তাই নয়, শেরে বাংলাকে নিয়ে অনেক কিংবদন্তী প্রচলিত থাকলেও সোহরাওয়ার্দীকে নিয়ে তেমন কোনো ঘটনা বা ইতিহাস কখনো শোনা যায়নি। অথচ বৃটিশ ভারতের সবচেয়ে মানবতাবাদী, গণতান্ত্রিক নেতা ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনিই প্রথম মুসলীম লীগের অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন।
শেখ মুজিবকে বাংলার নেতা হিসাবে তিনিই প্রস্তুত করেছিলেন। শেখ মুজিবকে সাথে নিয়ে ১৯৪৬-৪৭ এর অশান্ত দিনগুলোতে নিজের ভবিষ্যৎ বিসর্জন দিয়ে তিনি দাঙ্গা প্রতিরোধ করেছেন। এবং ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিতে ২৮ বছরের তরুণ শেখ মুজিবকে ঢাকায় পাঠান। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের প্রভাব যে কতটা স্পষ্ট, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটি পড়লেই ঝকঝকে হয়ে উঠবে। বইটিতে সবচেয়ে বেশি বার যার কথা এসেছে তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। প্রায় পুরো বইয়েই বঙ্গবন্ধু তাকে ‘শহীদ সাহেব’ বলে সম্বোধন করেছেন। সোহরাওয়ার্দী ছিলেন একাধারে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিতে আসার প্রেরণা, রাজনৈতিক পরামর্শদাতা এবং পরম শ্রদ্ধার পাত্র।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন যে রেসকোর্স ময়দানে দিয়েছিলেন তার ৭-ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, সেই স্থানটিকে স্বাধীনতার পর নামকরণ করা হয় এই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নামে। ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যান’ নামে পরিচিত জায়গাটি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম রূপায়িত হয়েছে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। আর সেই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একজন পুরোধা হিসেবে সোহরাওয়ার্দী স্মরণীয় হয়ে থাকবেন সবসময়।
ঢাকার হাইকোর্টের পাশে তিন নেতার মাজারে প্রখ্যাত এই নেতার সমাধি রয়েছে। তার জন্ম ও মৃত্যুদিবসে তার সমাধিতে আজও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এছাড়াও বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে তাকে স্মরণ করে থাকে। তবে একটি পীড়া বাঙালির অন্তরে চিরকাল থেকে যাবে। বাংলার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, বিকাশ ও এ অঞ্চলের জনগণের আর্থসামাজিক উন্নয়নে যে মানুষটি কাজ করে গেছেন সারাজীবন; নতুন প্রজন্মকে গণতান্ত্রিক চিন্তা চেতনা ও জনগণের সার্বিক কল্যাণে উদ্বুদ্ধ করবে যার জীবন ও কর্ম; সেই মহান মানুষটির মৃত্যুরহস্য পরিষ্কার হয়নি ৫৯ বছরেও। তবে এটির যে একেবারেই সম্ভব নয় তা কিন্তু নয়। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে দেখিয়েছি আমরা। তাহলে বাঙালীর জন্য নিবেদিতপ্রাণ এই মহানব্যক্তির মৃত্যুর কারণ এই ৫৯ বছর পরও যদি উন্মোচন করা হয়- সেটি হবে ইতিহাসের কাছে বাঙালির দায়মুক্তি।