1. chalanbeel.probaho@gmail.com : News :
  2. khokanhaque.du@gmail.com : khokan :
বৃহস্পতিবার, ১২ জুন ২০২৫, ০৬:০৯ অপরাহ্ন

দখল-দূষণে মৃত্যুর দ্বারে
ও মানুষ! শুনতে কি পাও? নদী আর চলনবিলের অব্যক্ত কান্না

আবুল কালাম আজাদ, গুরুদাসপুর (নাটোর)
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ৩ জুন, ২০২৫
  • ২৩ বার পঠিত

মানুষ নামের ভূমিদস্যুদের দখল দূষণে জীবন, পরিবেশ এবং জীববৈচিত্রের প্রাণ উপমহাদেশের  ঐতিহাসিক চলনবিল এবং চলনবিলের নদ-নদী মৃত্যুর দ্বারে কান্না করছে। চলনবিল আর চলনবিলের প্রাণ নদী, জলা, খাল বাঁচার জন্য মানুষের কাছে করুণ আকুতি জানাচ্ছে – “ও মানুষ! শুনতে কী পাও? নদী আর চলনবিলের অব্যক্ত কান্না?” 

নদী আর চলনবিল মা এবং সন্তানের নারীর বন্ধন। শিশু যেমন মায়ের নাড়ির প্রবাহ না পেলে বাঁচেনা, তেমনি নদীর পানির প্রবাহ না পেলে চলনবিলও বাঁচতে পারেনা। আর সেই নদী এবং প্রমত্তা চলনবিল আজ মানুষের বর্বর নির্যাতনে মৃত্যুর প্রহর গুনছে।

বড়াল-আত্রাই-নন্দকুঁজা-গুমানি নদীই হচ্ছে উপমহাদেশের বিখ্যাত ঐতিহাসিক চলনবিলের প্রাণ। চলনবিলের বুক চিরে প্রবাহিত প্রায় অর্ধশত ছোট-বড় নদ নদীর পানিই বাঁচিয়ে রেখছে চলনবিলের জীবনীসত্ত্বাকে। এই পানির প্রবাহেই প্রমত্তা নামে ইতিহাসে পরিচিত এবং গর্বিত চলনবিল। আমরাও চলনবিলের পরিচয়ে সমধিক পরিচিত হয়ে গর্ববোধ করি। পরিচয় দেই, আমরা চলনবিলের মানুষ। চলনবিলের জীবনীসত্ত্বাকে রক্ষা করতে চলছে গবেষণার পর গবেষণা, আন্দোলন, সেমিনার, ওয়ার্কশপ, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি।

এই ’চলনবিল’কে বাঁচাতে হলে সবার আগে বাঁচাতে হবে চলনবিলের প্রাণ সঞ্চালনকারী প্রধান নদ-নদী বড়াল-নন্দকুঁজা-আত্রাই-গুমানি, মরা আত্রাই, বারনই, গুড়, নারদ, মুসাখাঁ, বেশানি, ভাদাই, তুলসি, মির্জামামুদ এবং শাখা-উপশাখাসহ ১৫০ টি নদী, খাল ও জলাশয়কে। নাব্যতা  ফিরিয়ে বাড়াতে হবে পানির প্রবাহ। আমরা কী পারিনা নদী আর চলনবিলকে বাঁচাতে? মা এবং শিশুকে বাঁচাতে? উন্নয়নের নামে নদ-নদী, খাল- জলাশয় দখল-দূষণ নির্যাতনে নদ-নদীর নব্যতা ও অস্তিত্ব হারিয়ে গুমরে গুমরে ভাষাহীন অব্যক্ত কান্না করছে নদী আর চলনবিল। নদ-নদীর প্রবাহ না থাকায় উপমহাদেশের বিশাল জলাভূমি চলনবিল আজ পানিশূন্য মরুময়। হারিয়ে গেছে মাছ-পাখি, জলজ সম্পদ ও জীববৈচিত্র। পাল্টে গেছে জলবায়ু, পরিবেশ এবং মানুষের জীবনযাত্রা। ঝুঁকিতে চলনবিলের মানুষ-পরিবেশ।

নদী না বাঁচলে মানুষ বাঁচবেনা, চলনবিল বাঁচবেনা। তাই মানুষের জীবন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র রক্ষার্থেই নদী ও চলনবিলের জীবন বাঁচাতে হবে। বলা হয় নদীর সাথে জীবনের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। পরিবেশবাদীরা বলছেন, নদী না বাঁচলে চলনবিল, হাওর-বাওর ও পরিবেশ বাঁচবেনা। আর পরিবেশ না বাঁচলে মানুষ, প্রাণি, জীববৈচিত্র বাঁচবেনা। তাইতো নদী ও চলনবিলকে বাঁচাতে নানা প্রক্রিয়ায় চলছে আন্দোলন। গড়ে উঠেছে শত সংগঠন। চাপ বাড়ছে নীতিনির্ধারক ও সরকারের উপর।

ঢাকার চার পাশের নদীগুলোর নব্যতা রক্ষা ও দূষণ রোধে প্রণীত মহাপরিকল্পনার আলোকে সমীক্ষা প্রতিবেদন উপস্থাপন এবং সংশ্লিষ্ট প্রকল্প গ্রহণের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে এক সভায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন,’দেশকে রক্ষ করতে হলে নদীগুলোকে রক্ষা করতে হবে।’ আমরা যদি বাংলাদেশকে রক্ষা করতে চাই তাহলে আমাদের নদীগুলোকে বাঁচাতে হবে’। এছাড়াও তিনি নদ-নদী সুরক্ষায় কঠোর দিকনির্দেশনা দেন। (দৈনিক মানব জমিন,ভোরের ডাক,সময়ের আলো, প্রথম আলোসহ বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত-৫/১২/২০২৩)।

মানব সভ্যতার উন্নয়ন, জীববৈচিত্র এবং পরিবেশই গড়ে উঠেছে নদী কেন্দ্রিক। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, পৃথিবীতে যত সভ্যতা তার সবই গড়ে উঠেছে নদীর তীরে। ব্যবসা-বাণিজ্য, শহর, নগর সবই নদীর অবদান। মানুষের আর্থ-সামাজিক, জীব বৈচিত্র, পরিবেশ, জলবায়ূ , কৃষি-শিক্ষা, শিল্প, বাণিজ্য, সাংস্কৃতি, কৃষ্টি, ধর্ম সবকিছুর মুলে নদী। দিনে দিনে মানুষ নিজের স্বার্থে নদীর দুই কুলে জেগে ওঠা সিকস্তি-পয়স্থি ভূমি বিভিন্ন সময়ের সরকার ভূমি খেকো প্রভাবশালী, রাজনৈতিক নেতারা বেপরোয়া ভাবে দখল-দূষণ আর নির্যাতন করে নদীর টুটি টিপে মেরে ফেলছে। নগর, শিল্পকারখানার বর্জ্য ফেলে নদীর তলদেশ আর দুই পাড় ভরাট করে মেরে ফেলেছে নদি ও ঐতিহাসিক ’চলনবিল’কে। কোন বাধাই মানছেনা। আর এর সাথে জড়িত অসাধু ভুমি অফিসের কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালীরা এবং অপরিকল্পিত সরকারি অবকাঠামো নির্মাণ।

নদী ও নারী নির্যাতন সমানভাবে চলছে। এই নির্যাতন থেকে নদীর জীবনীসত্বাকে রক্ষা করতে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন(বাপা), বেলা, নদীরক্ষা আন্দোলন, চলনবিল রক্ষা আন্দোলন, আত্রাই-গুমানি-নন্দকুঁজা ও বড়াল রক্ষা আন্দোলন, নারদ নদ রক্ষা আন্দোলন কমিটি, জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা নানাভাবে আন্দোলন করে সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টি করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সরকার বিভিন্ন সময়ে আদালতের নির্দেশে কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ নিলেও প্রভাবশালী ভূমিখেকোদের কাছে নদী দখল উচ্ছেদ আর দূষণ রোধে সরকারের কর্মকর্তারা অসহায় হয়ে পড়েন। নদী কমিশনের চেয়ারম্যান নদী দখলে এক মহিলা মন্ত্রীকে ইঙ্গিত করে কথা বলায় চেয়ারম্যানকে পদই হারাতে হলো।

নদীর সঠিক মালিকানা নিয়েও চলছিল টানাহ্যাঁচড়া। নদীর মালিকানা নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) হয়ে উঠেছিল দূর্নীতির রাঘব বোয়াল। কথিত আছে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের অপরিকল্পিত প্রকল্পের কারণেই নদ-নদীর অপমৃত্যু হচ্ছে। নাটোর-৪ (গুরুদাসপুর-বড়াইগ্রাম) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য, চলনবিলের কৃতিসন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস বড়াল রক্ষা আন্দোলন কমিটি এবং বিভাগীয় সরকারী কর্মকর্তাদের সভায় অত্যন্ত ক্ষোভের সাথে বলেছিলেন, ‘আমি যদি এক ঘন্টার জন্যেও প্রধানমন্ত্রী হতাম তাহলে সর্বপ্রথম পানি উন্নয়ন বোর্ড বিলুপ্তির ঘোষণা দিতাম।’ উক্তিটি যথার্থই ছিল বলে নদী বিশেষজ্ঞদের অভিমত।

মহমান্য হাইকোর্ট নদ-নদীর দখল, দূষণ, ভরাট, সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে একটি ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করেন। একই সাথে মহামান্য আদালত নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয়-জলাধারের অবৈধ দখল ও দূষণকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করার আদেশ জারী করেছেন। রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ এর ৮৬ ও ৮৭ ধারা এবং ১৪৯(৪) ধারা অনুসারে জাতীয় নদী কমিশনকে নদীর জীবনীস্বত্বা রক্ষার মালিকানা প্রদান করে ঐতিহাসিক রায় প্রদান করেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নদী খেকোদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছিলেন। চলনবিল অঞ্চলের খ্যাতনামা সাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশি লিখেছেন, চারশত বছর পুর্বে এই বিলটি রাজশাহী, পাবনা, বগুড়ার অধিকাংশ স্থান জুড়ে বিরাজ করতো। ব্রহ্মপুত্র ও পদ্মার সঙ্গমস্থলের পশ্চিম উত্তরাংশে চলনবিল বিরাজিত। অবস্থান, আকৃতি ও প্রকৃতিতে দেখা যায়, চলনবিলকে উত্তর বাংলার নদ-নদী স্নায়ু জলের নাভি কেন্দ্র। কিন্তু অধ্যক্ষ আব্দুল হামিদের ‘চলনবিলের ইতিকথা’  বলে, ১৯১৬ সালে পাকশি- সিরাজগঞ্জ এবং পাকশি-শান্তাহার রেল লাইন করায় বড়াল, আত্রাই- নন্দকুঁজা-গুমানিসহ সংশ্লিষ্ট আরও নদ-নদীর প্রস্থ সংকুচিত হয়ে পড়ে। এখান থেকেই শুরু হয় চলনবিলের নদ-নদীর অপমৃত্যুর উদ্বোধন। এছাড়া, পদ্মা থেকে বড়ালের উৎস মুখ এবং আটঘড়ি দয়ারমপুরে বড়ালে তিনটি মরণ কোপাট (স্লুইস গেট) দিয়ে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ নিয়ন্ত্রন করে বড়াল নন্দকুঁজা, গুমানি, মুসাখাঁ, নারদ নদীর সাথে চলনবিলকে করেছে মৃত।

অন্তর্বতীকালীন সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রনালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডকে সাথে নিয়ে গত ১১ মে চারঘাটের বড়ালের মুখে সেই মরনকপাট (স্লুইস গেট) এবং চাটমোহর বড়াল অঞ্চল সরেজমিনে পরিদর্শন করে বাস্তবতা উপলব্ধি করে মৃত বড়ালের পানি প্রবাহ স্বাভাবিক করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জনগনের দাবির মুখে। এখন বাস্তবায়নের দিন গুনছে চলনবিলবাসী।

সুপারিশ:

আসুন আওয়াজ তুলি, নদী-জলা-জলাশয় রক্ষায় আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক সি এস রেকর্ড অনুযায়ী জরিপ করে সীমানা নির্ধারণ পূর্বক অবৈধ দখল উচ্ছেদ ও পুনঃখনন করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে। বড়াল ও নন্দকুঁজা নদীর তিনটি মরণকোপাট (স্লুইস গেট) সহ সকল অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হবে। পৌরসভা, হাট-বাজার এবং কল-কারখানার সকল প্রকার বর্জ্য নদীতে ফেলা বন্ধ করতে হবে। নদীর উপর স্থাপিত চারঘাট এবং আটঘড়িয়ার স্লুইস গেটসহ সকল প্রকার অবৈধ স্থাপনা অপসারণ করতে হবে। নৌ-পুলিশ গঠন করতে হবে। আর প্রতিবাদ নয়, প্রতিরোধ আর গণজোয়ার গড়ে তুলে নদী বাঁচাই, চলনবিল বাঁচাই, পরিবেশ, জীববৈচিত্র বাঁচাই ও মানুষ বাঁচাই।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..

সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত