আদমদীঘি উপজেলার মাদুর ও তাঁত শিল্প বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হস্তশিল্প, যা স্থানীয় জনগণের জীবিকা ও সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। বিশেষ করে নশরতপুর ইউনিয়নের শাঁওইল তাঁত এবং আদমদীঘি ইউনিয়নের হেলালিয়া হাট ও আশে পাশের এলাকা মাদুর শিল্পের জন্য বিখ্যাত।
মাদুর তৈরির প্রধান কাঁচামাল হলো “পাতি” নামক এক ধরনের ঘাস, যা দুইভাবে সংগ্রহ করা হয়।
বনপাতি (জংলি পাতি): প্রাকৃতিকভাবে ঝোপ-জঙ্গলে জন্মায়, কোনো চাষের প্রয়োজন হয় না।
চাষের পাতি: “মুথা” নামক গোড়া কেটে জমিতে পুঁতে চাষ করা হয়। ৭০-৮০ দিনের মধ্যে পাতি প্রস্তুত হয়, যা শুকিয়ে মাদুর তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
প্রাকৃতিক পাতি চাষ পদ্ধতি:
কৃষক বোরো চাষ পদ্ধতিতে পাতির বীজ মাটিতে বপন করে। প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ করে নিয়মিত এবং কমপক্ষে ৪ ইঞ্চি পরিমান পানি সবসময় মাটিতে থাকতে হবে। বোরো চাষের মতোই জমিতে সার, কীটনাশক ব্যবহার করার মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে পাতি বড় হতে থাকে। পাতি ৩ থেকে ৩.৫ ফিট লম্বা হলে তা কেটে রোদে শুকানো হয়। নিয়মিত পরিচর্চা এবং মাটি ভেদে পাতি ছোট বড় হয়ে থাকে। ছোট আকারের পাতিগুলো ঝেরে অপেক্ষকৃত ছোট পাতিগুলো বাছাই করে ঝুঁটি বেঁধে বাজারে বিক্রি করা হয়। যত কড়া রোদ হবে পাতি তত ঝকঝকে এবং উজ্জল হবে। আর উজ্জ্বল হলেই বাজারে এর চাহিদা অনেক বেশি এবং কৃষক দামও ভালো পেয়ে থাকে। কিন্তু মেঘলা আকাশে পাতির বং একটু কালচে হয়ে যায় এবং পাতির দামও কম পাওয়া যায়।
একবার পাতির বীজ বপন করলে কমপক্ষে ৭ থেকে ৮ বছর এক নাগারে পাতি পাওয়া যায়। যা বছরে ৩ বার করে কাটা যায়। এক বিঘা জমিতে প্রতি বারে কমপক্ষে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা ব্যয় হয়ে থাকে এবং ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা আয় করা যায় বলে, পাতি চাষীরা বলেন।
প্রাকৃতিক পাতি থেকে পাটি বুনন:
পাতি থেকে পাটি বুনানোর জন্য স্থানীয় মহাজনরা বাজার থেকে পাতি সংগ্রহ করে গ্রামের অস্বচ্ছল মহিলাদের কাছে সরবরাহ করে থাকে। মহাজনরা পূর্বে থেকেই পাটি বানানোর ফ্রেম, সুতলী এবং অন্যান্য উপকরণ সরবরাহ করে থাকেন। পাতি এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি হাতে পাবার পর থেকে গ্রামের মহিলা পুরুষেরা মহাজনদের চাহিদা মোতাবেক বিভিন্ন আকারের পাটি হাতে বানাতে শুরু করে। একটা পাটি বানাতে ২ জন মানুষের প্রায় ১ ঘণ্টা সময় লাগে। ২ হাত বাই ৪ হাত মাপের একটি পাটি বানানোর পারিশ্রমিক পান ৩০ টাকা। এভাবে এক জোড়া মানুষ একদিনে ৭-৮টি পাতির পাটি বানাতে পারে। পাটি বানিয়ে তারা বাড়িতে সংগ্রহ করে এবং এক সপ্তাহে প্রায় ১৫০০ টাকা থেকে ১৬০০ টাকা রোজগার করতে পারেন। সেই হিসেবে একজন পাটি প্রস্তুতকারক সপ্তাহে রোজগার করেন ৭০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা। সপ্তাহ শেষে মহাজনের লোকজন পাটি সংগ্রহ করে সেলাই মেশিন দিয়ে চারপাশ কেটে কাপড় দিয়ে সেলাই করে স্থানীয় এবং দেশের বিভিন্ন জায়গায় বাজারজাত করে থাকেন।
পাটিগুলো বানাতে বাড়ির কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাড়ির উঠানে, আম গাছের নিচে, পুকুর পাড়ে নিজেদের মধ্যে গল্প করতে করতেই করে থাকেন। এ জন্য তাদের বিশেষ কোন জায়গা কিংবা ঘর নেই। তবে প্রাকৃতিক নানা দৈব দূর্বিপাক বিশেষ করে বৃষ্টি বা ঝড় তুফানের সময় পাটির বানানোর কাজ ব্যহত হয়ে থাকে।
পাতি চাষ, বুনন ও বাজারজাত এলাকা:
বগুড়ার জেলার আদমদীঘি থানার হেলালিয়া হাটের পূর্ব ও পশ্চিম ছাতনী, সান্তাহারের মাদার মোল্লা এবং নওগাঁ জেলার রাণীনগরের ত্রিমোহনী এলাকায় প্রাকৃতিক পাতি তৈরি হয় । মাদুরের চাহিদা দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় সান্তাহার ইউনিয়নের সান্দিড়া, তারাপুর, কাজিপুর, ছাতনী, ঢেকড়া, প্রান্নাথপুর, পানলা, চকজান, দরিয়াপুর, সান্তাহার পৌরসভার মালশন, পাশের নওগাঁ সদরের শিমুলিয়া, ইলশাবাড়ি, চন্ডিপুর সহ বিভিন্ন এলাকা শত শত মানুষ পাতি থেকে মাদূর তৈরীর সাথে যুক্ত। এসব এলাকার ৯০ ভাগ মানুষ মাদুর শিল্পের সাথে জড়িত।
এমনকি বিভিন্ন হাটবাজারে আত্রাইয়ের চাপড়াগ্রামের মাদুরের ব্যাপক চাহিদা ছিল। এ জন্য ওই গ্রামসহ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন গ্রামে মাদুর তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করত শত শত পরিবার। আর এসব মাদুর তৈরির জন্য চাষ করা হয় পাতির। অতীত ঐতিহ্য ধরে রাখতে বদ্ধ পরিকর এবং আদমদীঘির সদর ইউনিয়নের হেলালিয়া হাট খুবই পরিচিত। যেখানে রবি ও বৃহষ্পতিবার দুইদিন পাতি এবং পাতির তৈরী পাটি বিক্রির হাট বসে। সপ্তাহের দুইদিন দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে খুচরা এবং পাইকারি ব্যবসায়ীরা পাতি এবং পাটি কিনতে আসেন। বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, বরিশালসহ বিভিন্ন শহরের পাইকাররা সরাসরি হাট থেকে মাদুর কিনে নিয়ে যান। এছাড়া, আদমদীঘির মাদুর ভারত, শ্রীলংকা, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, মিসর ও ইরাকসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এছাড়া নওগাঁ জেলার বিভিন্ন হাটবাজারের মধ্যে আত্রাইয়ের চাপড়াগ্রামের মাদুর বিশেষভাবে সমাদৃত।
প্লাষ্টিক পাটি:
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে মাদুরের চাহিদা বৃদ্ধির ফলে হাতের তৈরী পাতির পাটি চাহিদার সাথে যোগান দিতে না পারার ফলে বগুড়ার আদমদীঘিতে আধুনিকতার ছোঁয়ায় পাতির তৈরি পাটির পাশাপাশি মেশিনের তৈরি প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে তৈরি মাদুর এখন স্থানীয়সহ দেশের হাটবাজারগুলো দখল করে নিয়েছে।
ভারত থেকে প্লাস্টিক পাটির কাঁচামাল আমদানীর মাধ্যমে তৈরি হয় প্লাষ্টিকের মাদুর। দেখতে আকর্ষণীয় হওয়ায় প্লাস্টিকের তৈরি রং বে-রঙের চোখ ধাঁধানো পাতি (পাইপ) ও মাদুর তৈরির কারখানা স্থাপন ও বিক্রির ধুম পড়েছে। বাহারি রং ও নক্সা করা কৃত্রিম পাতির মাদুরের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় জমে উঠেছে মাদুর হাট ও কারখানা স্থাপন কার্যক্রম। পাইপ তৈরী ও মাদুর বুনুনের স্বয়ংক্রিয় কারখানায় চাকরির পাশাপাশি বহু বেকার নারী-পুরুষ নতুন প্রযুক্তির পাইপ দিয়ে বাড়িতে হাতে বুনুন করছে নক্সা ছাড়া মাদুর। আয়ও করছে বেশ। সপ্তাহে দুই দিন রবিবার ও বৃহস্পতিবার কাক ডাকা ভোর থেকে দুপুর পযর্ন্ত খুচরা ও পাইকারী বেচা-কেনার ধুম পড়ে যায় সান্তাহারের দেশবিখ্যাত হেলালিয়া হাটে। এখানকার হাতে ও স্বয়ংক্রিয় মেশিনে তৈরী বাহারী কারুকার্যে ভরা মাদুরগুলো দামে কম হওয়ায় এর চাহিদা ব্যাপক। ৩/৪ হাত লম্বা প্রতিটি প্লাস্টিক মাদুর নক্সা ভেদে পাইকারী ৮০ টাকা থেকে ১০০ টাকা পযর্ন্ত বিক্রি হয়। যা তৈরীতে খরচ পড়ে ৫০ টাকা থেকে ৭০ টাকা।
প্রাকৃতিক ও প্লাষ্টিক পাতির পাটি ও কাজের সুযোগ:
সান্তাহার ইউনিয়নের পুর্ব ও পশ্চিম ছাতনী, মাদার মোল্লা এবং রাণীনগরের ত্রি-মোহনী এলাকায় প্লাস্টিকের পাতি (পাইপ) তৈরীর কারখানা স্থাপন হওয়ার পর থেকে প্রাকৃতিক পাতি দিয়ে তৈরী মাদুরের পাশাপাশি প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে তৈরী মাদুরের চাহিদা দিন দিন বেশি হওয়ায় সান্তাহার ইউনিয়নের সান্দিড়া, তারাপুর, কাজিপুর, ছাতনী, ঢেকড়া, প্রান্নাথপুর, পানলা, চকজান, দরিয়াপুর, সান্তাহার পৌরসভার মালশন, পাশের নওগাঁ সদরের শিমুলিয়া, ইলশাবাড়ি, চন্ডিপুর সহ বিভিন্ন এলাকায় শত সহস্র বেকার মানুষ প্লাস্টিকের মাদুর তৈরী করে হাটে-বাজারে বিক্রির মাধ্যমে ভাল আয় করছে। বেকার থাকা মানুষগুলো স্বপ্ল পুঁজি বিনিয়োগ ও অল্প পরিশ্রম করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছে। এর মাধ্যমে স্বামীর স্বল্প আয়ের পাশাপাশি নিজের আয় যোগ হওয়ায় সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরে এসেছে। তারা সন্তানদের লেখাপড়ার উপকরণ কিনতে এবং পড়ালেখার বিষয়ে স্বামীর আয়ের উপর আর ভরসা করতে হয় না।
বর্তমানে এ ব্যবসা জনপ্রিয় ও লাভজনক হওয়ায় চাষ করা পরিবেশ ও স্বাস্থ্য সম্মত পাতির তৈরী মাদুর ব্যবসা হুমকির মুখে পড়ার আশংকা করা হচ্ছে। ব্যাপক চাহিদার কারনে সান্তাহার ও আশপাশে প্রায় ডজন খানেক প্লাস্টিক পাইপ তৈরীর মিল মাদুর তৈরীর প্রধান উপকরণগুলো সরবরাহ করতে হিমসিম খাচ্ছে। এই শিল্পে জড়িত কাজিপুর গ্রামের বিপুল সরদার জানান, আমরা পারিবারিক ভাবে অনেক আগে থেকেই মাদুর তৈরী ও বিক্রির সাথে জড়িত। প্রায় ২/৩ বছর ধরে আমি প্লাস্টিক মাদুর তৈরী করে বাজারজাত করি। জায়নামাজ মাপ তথা দুই বাই চার ফিট মাদুর আমি বেশি তৈরী ও বিক্রি করি। বর্তমানে এই ব্যবসা করে আমি স্বাবলম্বী হয়েছি। এই ব্যবসায় আয়ও ভাল । রংপুরের কাউনিয়া এলাকা খেকে প্লাস্টিক মাদুরের পাইকারী ক্রেতা রফিকুল ইসলাম জানান, আমি প্রায় দুই বছর ধরে এই এলাকা থেকে প্লাস্টিকের মাদুর পাইকারী দরে কিনে খুলনায় বিক্রির জন্য নিয়ে যাই। ওই এলাকায় এই মাদুরের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ফলে আমার আয় ভালই হচ্ছে।
সান্তাহার পৌর শহরের চা-বাগান মহল্লার বাসিন্দা আলহাজ্ব নুরুল ইসলাম শুকুর জানান, প্রায় দুই বছর আগে আমার গ্রামের বাড়ি শিমুলিয়ায় প্রায় তিন একর জায়গার একাংশে প্লাস্টিক পাইপ ও মাদুর তৈরীর স্বয়ংক্রিয় কারখানা চালু করি। প্রথম দিকে চাহিদা কম থাকলেও বর্তমানে এই শিল্পের ব্যাপক চাহিদার কারনে আমার ব্যবসা ভাল হচ্ছে।
আধুনিক প্লাস্টিক মাদুরের আগমনে ঐতিহ্যবাহী পাতি মাদুরের চাহিদা কিছুটা কমেছে। তবে, আদমদীঘির মাদুরের টেকসইতা ও নান্দনিকতার কারণে এর চাহিদা এখনও রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রশিক্ষণ, ঋণ সুবিধা ও বাজার সম্প্রসারণের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরীর মাধ্যমে এই শিল্পকে আরও সমৃদ্ধ করা সম্ভব। তাছাড়া গ্রামীন মহিলাদের পাটি বুনানোর মজুরী কম দিয়ে মহাজনরা চুষে বড়লোক হচ্ছে। তাই মজুরী বৃদ্ধি করতে হবে বলে অনেকে মত প্রকাশ করেন ।
ছাতনী গ্রামের বাসিন্দা প্রাকৃতিক পাতির মাদুর ব্যবসায়ী বুলা আহম্মেদ এবং মাদুর ক্রেতা সান্তাহার পৌরসভার মালশন গ্রামের আব্দুল মজিদ, হেলালিয়া হাটের প্রতিষ্ঠিত প্লাষ্টিক ও প্রাকৃতিক পাতির পাটি ব্যবসায়ী বললেন ভিন্ন কথা। তারা বলেন, প্রথম দিকে প্লাস্টিক মাদুরের ব্যপক চাহিদা থাকলেও কোভিড-১৯ এর পর থেকে প্লাষ্টিকের মাদুরের চাহিদা ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। কারণ প্লাষ্টিকের মাদুরের কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানী করতে হয়, পাটি দামে কম কিন্তু অপচনশীল। তাছাড়া এর পেছনে ঝক্কি ঝামেলাও অনেক বেশি। অন্য দিকে প্রাকৃতিক মাদুর স্বাস্থ্যসম্মত, টেকসই, হাতে তৈরী করা যায়, পচনশীল ও পরিবেশ উপযোগী, লাভজনক হওয়ায় এই মাদুরের উৎপাদন ও চাহিদা বাড়বে বৈ কখনও কমবে না।
লেখক:
গবেষক ও বিশেষ সংবাদদাতা, চলনবিল প্রবাহ
ইমেইলঃ tozammel.dascoh@gmail.com